Porjotonlipi

রেমা-কালেংগা রিসার্ভ ফরেস্ট

রিসার্ভ ফরেস্ট রেমা কালেংগা , নামটি কি আগে শুনেছেন? যদি শুনেও থাকেন, তবে চলুন জেনে আসি এর বন্য বৈচিত্র সম্পর্কে। আমরা জানি, বাংলাদেশ বন-বনানী তথা সবুজে ঘেরা একটি দেশ।

রিসার্ভ ফরেস্ট রেমা কালেংগা

এই বনাঞ্চল গুলি দেশের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য রক্ষা ও বাস্তু তন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষা করে যাচ্ছে যুগ যুগ ধরে। তেমনি একটি বনাঞ্চল হলো রিজার্ভ ফরেস্টরেমা-কালেঙ্গা যা সুন্দরবনের পরে এ দেশের সর্ববৃহৎ প্রাণীর অভয়ারণ্য ও প্রাকৃতিক বনভূমি। পর্যটন লিপির এই আলোচনায় আমরা জানতে বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলায় অবস্থিত এই রিজার্ভ ফরেস্ট রেমা-কালেঙ্গা সম্পর্কে।

Rema2

অবস্থান:

রেমা-কালেঙ্গা বনাঞ্চলটি সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলা অবস্থিত। এটি মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার খুব কাছে অবস্থিত এবং ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত সংলগ্ন। আপনার যদি ভবিষ্যতে শ্রীমঙ্গলে বেড়াতে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা থেকে থাকে, তবে আমার অনুরোধ রইলো যে আপনি এ রিজার্ভ ফরেস্ট রেমা-কালেঙ্গা টি অবশ্যই ঘুরে আসবেন।

আয়তন:

রিজার্ভ ফরেস্ট রেমা-কালেঙ্গা, বনাঞ্চলটি মূলত চারটি অঞ্চলে বিভক্ত। এগুলো হলো রেমা-কালেঙ্গা ছনবাড়ি ও রাশিদপুর। এর আয়তন প্রায় ১৭৯৫ হেক্টর। ১৯৪০ সালের দিকে এই বনভূমি বিস্তার লাভ করতে শুরু করে। তবে ১৯৮২ সালে এটি অভয়ারণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় যা ১৯৯৬ সালে আরো সম্প্রসারণ করা হয়। এখানে রয়েছে বেশকিছু পাহাড়ি টিলা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এখানকার পাড়াগুলোর সর্বোচ্চ উচ্চতা ৬৭ মিটার।

Rema3

জীব বৈচিত্র:

এই বনাঞ্চলটি বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য একটি সংরক্ষিত শুকনো ও চিরহরিৎ বনাঞ্চল। এখানে পাওয়া যায় প্রায় ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ীী, ৭ প্রজাতির উভচর, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ এবং প্রায় ১৬৭ প্রজাতির পাখি। এছাড়াও প্রায় ৬৩৮ প্রজাতির গাছপালা লতাগুল্ম পাওয়া যায়় এখাানে। রয়েছে কিছ বিরল প্রজাতির পাখি, তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বসন্ত বৌরি, সিপাহী বুলবুল, মথুরা, বনমোরগ, কাও ধনেশ, ভীমরাজ, লালমাথা কুচকুচি, শ্যামা, শামুক খাউরি প্রভৃতি। বিরল প্রজাতির মালায়ন ও বড় কাঠবিড়ালি একমাত্র এই বনে পাওয়া যায়। এখানে আরও ৫ প্রজাতির কাঠবিড়ালি দেখা পাওয়া যায়। এই বনে উল্টালেজী বানর, রেসাস ও নিশাচর লজ্জাবতী এই তিন প্রজাতির বাঁদর বাস করে। রয়েছে মুখ পোড়া হনুমান ও চশমাপরা হনুমান। এখানেই শেষ নয়, এ বনে আরো বাস করে উল্লুক, মেছোবাঘ, গন্ধগোকুল, মায়া হরিণ, বেজি, সজারু,‌ দেশি কাল বন্যশুকর, খরগোশ, মেছো বিড়াল, বনকুকুর, রামকুত্তা সহ বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী। এবার আসি সাপের প্রসঙ্গে, কোবরা, দুধরাজ, লাউডগা প্রভৃতিসহ আরও ১৮ প্রজাতির সাপের খেলার দেখা মেলে এই রেমা-কালেঙ্গা বনে।

উদ্ভিদবৈচিত্র্য:

এই বন, রিজার্ভ ফরেস্ট রেমা-কালেঙ্গা, উদ্ভিদবৈচিত্র্যে এদেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ বনাঞ্চল। এখানে রয়েছে ৬৩৮ প্রজাতির উদ্ভিদ। এই বোনের উল্লেখযোগ্য উদ্ভিদসমূহ হলো – সেগুন, আউয়াল, হারগাজা, হরীতকী, বহেড়া, জাম, ডুমুর, গন্ধারি, কাক্কর, নেউর, বহেরা, কাউ কদম, চাপালিশ, নিম ইত্যাদি।

কিভাবে যাবেন:

রেমা-কালেঙ্গা রিজার্ভ ফরেস্ট যদি আপনি ঢাকা বা সিলেট থেকে বাসে বা ট্রেনে করে যেতে চান তাহলে আপনাকে নামতে হবে শায়েস্তাগঞ্জ বা শ্রীমঙ্গল স্টেশনে। ঢাকা থেকে এর দূরত্ব প্রায় দুইশ ত্রিশ কিলোমিটার। ট্রেনে করে যেতে ভাড়া লাগবে ১২০ থেকে ৬৭০ টাকা আর বাসে লাগবে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। যাত্রাপথে ট্রেন থেকে নেমেই এখান থেকে রেমা অথবা কালেঙ্গা বনের যেকোন প্রান্তে যাওয়ার জন্য সিএনজিচালিত অটোরিকশা পাওয়া যাবে, ভাড়া ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। উল্লেখযোগ্য যে, এই বনের দুই প্রান্তের নাম রেমা-কালেঙ্গা। এই দুই প্রান্ত থেকেই বনে প্রবেশ করা যায়। যদি রিমা দিয়ে প্রবেশ করতে চান তাহলে খোয়াই নদীর খেয়া ঘাটে নামতে হবে। এই খেয়া ঘাট থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার হেঁটে গেলে বনের রেমা প্রান্তে পৌঁছে যাবেন। এই হাঁটার পথে চোখে পড়বে চা বাগান আর ছোট ছোট আঁকাবাঁকা টিলা। পুরো বনজুড়ে ৩টি প্রধান ট্রেইল। রেমা প্রান্ত দিয়ে হাঁটা শুরু করলে কালেঙ্গা প্রান্তে পৌঁছাতে সময় লাগতে পারে দেড় ঘন্টার মত। আর কালেঙ্গা প্রান্ত থেকে বনে প্রবেশ করতে চাইলে শ্রীমঙ্গল থেকে কালেঙ্গার জীপ ভাড়া ২ থেকে ‌৩ হাজার টাকার মতো তবে চাইলে রশিদপুর বিট হয়েও যাওয়া যায় বনের ভিতরে কিন্তু এই রাস্তায় বেশ সময় সাপেক্ষ।

Rema1

কোথায় থাকবেন:

এই বনে রয়েছে বনবিভাগের বিশ্রামগার। এখানে অবস্থান করতে চাইলে সিলেটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তার অনুমতি নিতে হবে। থাকার জন্য আপনি বেছে নিতে পারেন নিসর্গ তরফ হিল কটেজ চাইলে ক্যাম্পেইন ও করা যাবে এখানে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য:

পুরো বনকে হেঁটে দেখার জন্য রয়েছে তিনটি ট্রেইল বা পথ। প্রতিটি পথই অত্যন্ত সুন্দর আর সাজানো। এখানে বনের ভেতরে রয়েছে অসম্ভব সুন্দর একটি লেক। বন্যপ্রাণীদের খাবার পানির চাহিদা মেটাতেই এ লেকটি মূলত তৈরি করা হয়েছিল। এই লেকটির পাশেই রয়েছে সুউচ্চ একটি ওয়াচ টাওয়ার। এই ওয়াচ টাওয়ারে উঠলে দেখা যাবে বোনের অকৃত্রিম অসীম সৌন্দর্য। যতদূর চোখ যাবে আপনি দেখতে পাবেন শুধু সবুজ আর সবুজ। বলাবাহুল্য যে যেহেতু বন্টি প্রাকৃতিক তাই এই বোনের দেখভালের বোনটিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য রয়েছে ৭ টি ক্যাম্প ও ১১ টি ইউনিট।

আদিবাসীদের জীবনযাত্রা:

রেমা-কালেঙ্গা বনের ভিতরে বাস করে মোটামুটি সম্প্রদায়ের অধিবাসী। ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকটি পাড়ার রয়েছে এখানে। তবে সাঁওতাল তেলেগু এবং উরোং অধিবাসীদের সংখ্যাও অনেক কম না বললেই চলে।

শেষ কথা:

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বনাঞ্চলগুলোর মধ্যে এটি একটি যা কিনা এখন নির্বিচারে গাছ চুরি ও বন ধ্বংসের কারণে হুমকির সম্মুখীন হয়ে রয়েছে। নির্বিচারে এই বন থেকে গাছ চুরি প্রতিরোধে আমরা পর্যটনলিপি টিম সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে আরও সচেষ্ট হওয়ার অনুরোধ করছি। প্রশাসনের একটি শক্ত পদক্ষেপই পারবে এই রিজার্ভ ফরেস্ট রেমা-কালেঙ্গা বনের ভেতরের বন্যর্বৈচিত্র্য কে রক্ষা করতে। আর পর্যটকদের কাছে আমাদের অনুরোধ রইল যে, এমন কিছু না করা যা বনের অভ্যন্তরীণ পরিবেশকে নষ্ট করবে। আমরা পর্যটকরাই সচেতনভাবে পারি এদেশের পর্যটনশিল্পকে আরও সমৃদ্ধ করতে।

কন্টেন্ট রাইটারঃ নূর ফাতিহা তাহিয়াত 

 

Porjotonlipi Desk

Add comment