বেশ কিছুদিন আগে একটি সিনেমা দেখেছিলাম। সিনেমাতে নায়ককে বাক্সবন্দি করা হয়। বাক্স থেকে দাপাদাপি করে বাক্সের ডালা ভেঙ্গে যখন নায়ক বের হয়ে আসে, তখন সে বুক ভরে শ্বাস নেয়। কোয়ারেন্টাইনের এই বাক্সবন্দি জীবন শেষে একটু সবুজেভরা সতেজ বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য আমাদের প্রান পাগল প্রায়।
বান্দরবানের আলীকদম ট্যুর (আলীকদম থেকে তামাংঝিরি)
ঠিক এমন সময়ই হঠাত আশার বানী শোনালেন আমাদের প্রিয় রয়েল ভাই একটি প্রাণবন্ত বান্দরবানের আলীকদম ট্যুর এর আয়োজন করে। যদিও তখন আর্মিদের অনুমতি পাওয়া তখন শুরু হয়নি, কিন্তু সে সমস্যাটা সমধান করে ফেললেন আমাদের গ্রেট রয়েল ভাই পারমিশন এর ব্যবস্থা করে। উদ্দেশ্য বান্দরবানের আলীকদম ট্যুর। আর সেখানেই আছেন আমাদের সবার প্রিয় মনিকান্ত দাদা। আমাদের ভ্রমনের তৃষ্ণা আর দাদার আমন্ত্রন যেন দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে গেল। ভ্রমন শুরু করলাম আগস্টের ১৪ তারিখ সকাল বেলা নতুন চান্দগাও থেকে। এখানে এসে এস আলম বাসের টিকিট কেটে বাসে চড়ে বসলাম। দুই আসনে একজন যাত্রী এবং ভাড়াও দ্বিগুন। তাতে কি, ভ্রমন নেশায় আমরা সবাই তখন পাগলপ্রায়।
বান্দরবানের আলীকদম ট্যুর শুরু
প্রায় দেড়ঘন্টার যাত্রা শেষ করে পৌঁছে গেলাম আমরা আলীকদমে। এখান থেকে চাদের গাড়ি ভাড়া করে রওনা দিলাম পানবাজার মনিকান্ত দাদারবাড়ি। এখানে বলে রাখা দরকার দুটি আর্মি ক্যাম্প পড়ে এবং আর্মি ক্যাম্প থেকে পারমিশন নিয়ে আমরা শেষ পর্যন্ত পৌঁছলাম মনিকান্ত দাদার বাড়ি। বাড়ি ঢুকতেই চোখে পড়ল ছায়াঘেরা টলমল পানির পুকুর। এ দৃশ্য দেখে চুপচাপ বসে থাকা যায় না। পুকুরে নেমে যখন পানিতে গা ভাসিয়ে দিলাম, আমাদের সমস্ত ক্লান্তি যেন নিংড়ে কোথায় ফেলে দিয়ে আসল প্রকৃতির স্পর্শগুলো। বেশ কিছুদিন পরে এমন পরশ, আহা!
খাবার পর্ব
স্নান শেষে এখন খাবার আয়োজন ।সব কিছু দাদার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়। একটা একটা করে আইটেম বলছি, সিদ্ধ তরকারির সাথে মরিচের চাটনী, টকপাতা দিয়ে মুরগির স্যুপ, মুরগী ভুনা, ডাল আর সব থেকে আকর্ষনীয় বাশকরুল ভাজি। এর স্বাদ অনেক নবাবী ভোজকে অনায়াসে হার মানিয়ে দেয়। দিদির হাতের রান্নার তুলনা করা টাও হবে বোকামি।চাইলে আপনারা হোটেলেও খেতে পারেন, কিন্তু এই ট্রেডিশনাল খাবারের স্বাদ জীবনে একবার হলেও নেইয়া উচিত। এ রান্নার অন্য একটা বড় দিক হল কাঁচা মরিচের রান্না সত্ত্বেও বুক জ্বালাপোড়া নেই, নেই কোন ঢেকুর। আমাদের সবাই যেভাবে খেয়েছে ত দেখে যে কারও মনে হতে পারে আমরা অনেকদিন ধরে খেতে পাই না।
অ্যাডভেঞ্চারের পথে যাত্রা
খাবার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আসল গন্ত্যব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। পথে পানবাজার থেকে কিছু বাজার সদাই নিয়ে গেলাম রাতের খাবার এর জন্য। গ্রামগঞ্জে অদ্ভুত নামের কিছু গাড়ি চলে। এর মধ্যে একটা হল টমটম ।আমরা টমটম এ চড়ে পানবাজার থেকে বোটঘাটে গেলাম। সেখান থেকে বোট ভাড়া করে দোছড়ী নামক বাজারের উদ্দেশে চলছি তখন। আশেরপাশের তাকাতেই চোখে পড়ল জুম চাষ করা পাহাড়। এইসব প্রাকৃতিক দৃশ্য থেকে চোখ ফেরানো দায়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিমোহিত আমরা প্রায় দুই ঘন্টার বোট ভ্রমন শেষে এসে পৌছলাম দোছড়ি বাজারে। সেখানে আমাদের চা পান বিরতি, তবে বেশিক্ষণ নয়। এরপর ট্রেকিং শুরু করলাম রাইতমনি পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। হঠাৎ হঠাৎ পথের মাঝে পাহাড়ের সৌন্দর্যের মুগ্ধতায় আমরা হারিয়ে যাই। পাহাড় আর খালের মিলন এক ভাষাহীন মুগ্ধতার জন্ম দিয়ে চলেছে। খাল পার হতে হয় চার পাচবার এর মত, কিছু জায়গায় হাল্কা ভারি স্রোত ও আছে। বলে রাখা ভালো সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত এসব জায়গায়, বিশেষ করে জুতা পরিধানেও সতর্কতা প্রয়োজন।
দ্বিতীয় পর্ব
রাতের খাবারটা গুরুত্বপূর্ন, তাই মাঝের এক পাড়া থেকে দেশি মুরগী নিয়ে নিলাম রাতের জন্য।এখান থেকে ২০-২৫ মিনিট হাটার রাস্তা শেষ করে এসে পড়লাম রাইত্মুনি পাড়া। তখন খানিকটা ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি আর রোদের এক অন্যরকম মেলবন্ধনে চোখের সামনে ভেসে উঠলো রংধনু। এ কি অদ্ভুত সৃষ্টি রঙ এর। এরই মধ্যে আমরা পানিতে নেমে পড়লাম। ছবি তোলা থেকে শুরু করে রংতামাশা, হাসিঠাট্টায় মাখানো মূহুর্ত গুলো আমাদের কাছে যে কি পরিমান প্রিয় হয়ে উঠেছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। স্নান শেষে সেখানেই দাদার আত্মীয়ের বাড়ি রাতটা কাটিইয়ে দিব বলে ঠিক হল। এ এক আলাদা অনুভুতি ।পুরো পাহাড়ে মাত্র দুইটি বাড়ি। এখান থেকে দূরে পাহাড় আর ছোট ছোট বাড়ি দেখা যায়। আমরা তাবু করলাম।
বান্দরবানের আলীকদম ট্যুর এর আনন্দ – উল্লাস
তারপর আমাদের বারবিকিউ বানানোর কার্যক্রম শুরু হল। সন্ধ্যা নেমে যখন রাত ঘনিয়ে এল প্রকৃতি যেন রূপ বদলে ফেলল। আকাশ উজাড় করে দিল তার সৌন্দর্য। আমার জীবন কালে এত তারা একসাথে আকাশে দেখি নি। এসব জায়গায় ভালো ছবি তুলতে পারে এমন মানুষের সাথে থাকা খুব প্রয়োজন। তার প্রমান দিলেন ইমরান ভাই, এনাম ভাই,রাহুল দাদা , লিও ভাই মিল্কিওয়ের অসাধারন কিছু ছবি তুলে। এর মধ্যে আমাদের গান উনো খেলা আর আড্ডা কোনটাই বাদ যায় নি। মজার বিষয় হচ্ছে কিছুক্ষণ পরপর বৃষ্টি তো পরছেই। সাথে দেশি মুরগি বাশকোরল রান্না আর বারবিকিউ এর স্বাদ আমাদের সময়গুলোর পরিপূর্নতা দিয়ে দিল।
সুপ্রভাত
যেন স্বপ্নময় অবাস্তব জগতের রাত শেষে ঘুম ভাংলো আমাদের পাহাড়ে মোরগের ডাকে। চোখ খুলে সামনে দেখালাম মেঘের লুকোচুরি। এর পর ব্রেকফাস্ট শেষ করে তামাংঝিড়ির দিক যাত্রা আরম্ভ করলাম। আমারা নয়জন যাত্রী এবং সাথে ছিলেন মনিকান্ত দাদা। দাদার সাথের ছিল মিষ্টি দেখতে দাদার মেয়ে। ঝর্ণায় যাওয়ার পথ মোটামুটি সুগম কিন্তু কষ্টসাধ্য। কিছু জায়গা দুর্গম ও বলা চলে। কিছু যায়গা ভয়ংকর দুর্গম। একটু অসাবধান হলে পা পিছলে একদম খালে গিয়ে পড়তে হবে। আমরা কম বেশি সবাই একটু আধটু পড়েছি। কিন্তু পাহাড়ী মায়ার টান, সৌন্দর্য আপনাকে প্রতি মুহুর্তে আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে রাখবে এ আমি হলফ করে বলতে পারি। আর বান্দরবানের আলীকদম ট্যুর আমাদের কাছে অন্যতম।
সাবধানতা
বেশ কিছুটা পথ যখন পাড়ি দিয়ে পাহাড়ি ঝর্নায় পৌঁছলাম ,আমাদের ক্লান্তি তখন নিমিষেই গায়েব। তবে পাহাড়ে যাবার আগে খালটি ছিল অত্যন্ত খরস্রোতা, তাই এটি পার হতে হবে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে। এ কাজটি করে দিয়েছেন আমাদের মনিকান্ত দাদা। দাদা সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে আমাদের পার কর দিয়েছেন। প্রায় তিন চার বার এরকম খাল পার হতে হবে। ভারি কিছু এ পথে না আনাই শ্রেয়, তা না হলে কষ্ট বেড়ে যাবে কয়েকগুন। তামাংঝিড়ি ঝর্নার সামনে আমরা। মোটামুটি আকারের ঝর্ণা। এখনো মানুষের পদচারনা কম বলে ঝর্নার পানি অত্যন্ত স্বচ্ছ। এখানকার অধিবাসীরা এ ঝর্নার পানিই পান করে। একদম শেষে চলে আসছি। ঠিক একই ভাবে ফিরে আসলাম আমরা। যাওয়ার পথে আর্মি চেকপোস্ট পড়বে দুইটা। অবশ্যই সাথে আসল NID এবং দুটি ফটোকপি নিয়ে যাবেন। আর এটাই ছিল আমাদের বান্দরবানের আলীকদম ট্যুর ।
কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য
আমাদের সমগ্র ট্যুর প্রানবন্ত হওয়ার কারণ মণিকান্ত দাদা। তিনি না বললে এরকম এক জায়গার মায়া থেকে বঞ্চিত হতাম, দেখারও সুযোগ হত না। আমাদের খরচ জনপ্রতি ৩০০০ টাকা পড়েছে। তবে বাজেট থেকে কিছু টাকা হাতে রাখাটা প্রয়োজন। আপনারা চাইলে এই মায়াবি সময় উপভোগ করতে পারেন, হারিয়ে যেতে পারেন কোলাহল থেকে স্বপ্নময় জগতে। প্রকৃতির মায়াময় খেলায় বরং নিজেকে একটু বিলিয়েই দিন। যেতে চাইলে অবশ্যই মনিকান্ত দাদার সাথে যোগাযোগ করবেন। গুগল ম্যাপে এ জায়গায়র সন্ধান পাওয়াটা চিন্তার বাইরে। দাদার সাথে যোগাযোগ এর ফোন নং- ০১৮১৩০৭৫১২৫
বিশেষ দ্রষ্টব্য-
আপনি প্রকৃতির একটি অংশ। প্রকৃতি আপনাকে দু হাত উজাড় করে দিয়েছে। একারনেই বেশ কিছুটা দায়িত্ব পরে আপনার, আমার, আমাদের সবার কাধে। প্লাস্টিক পলিথিন ভ্রমনে প্রয়োজনীয় জিনিস, তবে ব্যবহারের পরে তা যথাস্থানে ফেলে অথবা সাথে করে নিয়ে আসবেন।
কন্টেন্ট ও ছবিঃ Piyal Mutsuddy
Its such as you reаd my thoughts! You seem to know so mսсh approximately this,
suсh as you wrote the guide in it oг something. I believe that you just can do
with a few percent to ԁrive the message
house a little bit, but instead of that, that is great blog.
A great read. I’ll definitely be back.