Porjotonlipi

বাংলাদেশের ঐতিহ্য – পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার

শাঁখারীবাজার পুরান ঢাকার সবচেয়ে পুরনো এবং জনপ্রিয় ঐতিহ্যবাহী একটি  স্থান। পুরান ঢাকা বেড়াতে এসে যারা এই শাঁখারীবাজার ঢুঁ দেননি, তারা নিজেদের এক বিশেষ জায়গা পরিদর্শন করা থেকে বঞ্চিত করেছেন। 

হিন্দু সভ্যতার পরিচয় বহনকারী এই শাঁখারীবাজার

পুরান ঢাকা মানেই গলি আর ঘুপচি – এই কথা আমরা অনেকের থেকেই শুনেছি, এবং সত্যিই তাই। পুরান ঢাকার প্রতিটি সড়কেই রয়েছে নাম জানা- অজানা অনেক অলিগলি। কিন্তু শাঁখারীবাজার পুরান ঢাকার অন্যান্য অলিগলির চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা এবং এই নির্দিষ্ট এলাকার যেন রয়েছে একটা অন্যরকম ভাবভঙ্গি। 

পুরান ঢাকার জজ কোর্টের পাশের গলি দিয়ে ঢুকলে নিজের কাছে মনে হতে থাকে যেন এক পাতালপুরীতে চলে এসেছি। ধুপ-সিদুরের ঘ্রান আর ঘণ্টা – কাসার আওয়াজে চারিদিকে সবসময় বিচরণ করে সাজসাজ রব। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন পূজা-পার্বণে শাঁখারীবাজার যেন সেজে ওঠে পুরোপুরি ভিন্ন এক সাজে। 

পুরাতন সভ্যতার এক খণ্ড এই শাঁখারীবাজার

শাঁখারীবাজার ঢুকলে মনে হবে যেন এক গোলকধাঁধার মধ্যে চলে এসেছি। হাজার হাজার সরু গলি এবং অজস্র মানুষের ভীরে নিজেকে মনে হবে ক্ষুদ্র এক প্রাণী। এখানে বেড়াতে আসলে সর্বপ্রথম যে কাজটি করা উচিত তা হল, শাঁখারীবাজার বা আশে- পাশের এলাকার স্থানীয়  কাওকে নিয়ে ঘুরতে আসা, যারা এই পাতালপুরীর সবটা চিনে, নাহলে এখানে হারিয়ে গেলে রাস্তা খুঁজে পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। 

এই এলাকা যেন হরপ্পা বা মহেঞ্জো দারো নামক সভ্যতার কোনো এক শহর। এখানকার বাসাবাড়ি গুলো যেন অন্তত সেটুকুই জানান দেয়। এখানকার বাসাগুলো সবগুলো দেখতে অনেকটা একই রকম, দেখলে মনে হবে হাজার বছরের পুরাতন, ধ্বসে যাওয়ার মত অবস্থা। একটা দালান থেকে পার্শ্ববর্তী দালানের দূরত্ব এমন, একজন মানুষ সেখান দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে চলাচল করতে পারবে না, কিন্তু সেখানেই হাজার হাজার মানুষের বসবাস। দালানের ভিতরে রয়েছে উপরে ওঠার জন্য সিঁড়ি, যেগুলো বেশ খাঁরা এবং চিলেকোঠা বেশ সরু। কথিত আছে এমন নকশার সিঁড়ি বানানোর পিছে রয়েছে অজানা কোন এক কারণ।  দালান গুলোতে দরজা জানালার সংখ্যা খুবই কম, ঘরগুলোতে ঢুকলে মনে হবে কোন কুঠরির মধ্যে আছি, কারণ সেখানে আলো বাতাসের উপস্থিতি নগন্য। কিন্তু দালানগুলোর দ্বিতীয় তলার পাশের জায়গাগুলো বেশ খোলামেলা, দেখতে অনেকটা খোলা বারান্দার মত। সেখান থেকে দেয়াল টপকে পাশের বাড়ির ছাদে অথবা বারান্দায় দিব্যি চলাচল করা যায়। 

এইতো গেল বাসা- বাড়ির কথা। এবারে আসি বাণিজ্যের আলাপে। যেহেতু এই শাঁখারীবাজার বেশ বড় রকমের এক হিন্দু পল্লী, সুতরাং এখানকার সিংহভাগ ব্যাবসা- বাণিজ্য সেরকমই। সেখানে রয়েছে অগণিত স্বর্ণালঙ্কারের দোকান, শাঁখা- সিঁদুর, দেব-দেবীর মূর্তি সাজানোর পসরা, হরেক পদের মিষ্টান্নর দোকান। রয়েছে অগনিত মন্দির এবং উপাসনালয়। শাঁখারীবাজারের দালানগুলোর মাঝে রয়েছে যেমন চিপা, সেই এলাকার রাস্তাঘাটও তেমন সরু, সেখানে রিকশা নিয়ে প্রবেশ করলে দীর্ঘ যানজট পরে যায়। সুতরাং পুরোটা শাঁখারীবাজার পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখাই উত্তম। সরু হোক, কিংবা ঘুপচি – এর মধ্যেই নিহিত আছে ঐতিহ্যবাহী শাঁখারীবাজারের শত বছরের সৌন্দর্য। দিনে-দুপুরে সেই রূপ ফুটে না উঠলেও সন্ধ্যে হবার সাথে সাথে শাঁখারীবাজার যেন পাল্টে যায় উজ্জ্বল রূপ নিয়ে। দোকানপাট এবং বাসাবাড়িতে বাতি জ্বলজ্বল করে, আগরবাতি- সিঁদুরের ঘ্রান, ঘণ্টা- কাসার আওয়াজ, মানুষের হইচই আর কোলাহলে মুখরিত হয়ে যায় পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার। আসে পাশের স্থানীয়রা ছাড়াও দুরদুরান্ত থেকে অনেক মানুষ এই শাঁখারীবাজার দেখতে চলে আসে। বিভিন্ন পূজা, বাংলা নববর্ষ, পৌষ সংক্রান্তি, এবং নাম না জানা অনেক উৎসব- পার্বণেই এই শাঁখারীবাজারকে দেখা যায় রঙিন এক রূপে। 

খাবারপ্রেমিদের আরেক আড্ডার জায়গা এই শাঁখারীবাজার

শাঁখারীবাজার এবং ইসলামপুর এর রাস্তায় রয়েছে বেশ কিছু কাচ্চি, বিরিয়ানি এবং মিষ্টি- মণ্ডার দোকান, যেখানে প্রতিদিন অনেক মানুষ খেতে আসেন। বিরিয়ানি ছাড়াও দোকান গুলোতে মিলবে বোরহানি, নানা পদের কাবাব। মিষ্টির দোকান গুলোতে মিলবে মিষ্টির পাশাপাশি ঘোল, দধি, লেবুর শরবত আরও অনেক কিছু। 

পুরান ঢাকায় গলি-ঘুপচি আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু ঘুপচির সবটা জায়গায় রয়েছে পুরান ঢাকার নিজস্ব পরিচিতি এবং ঐতিহ্য, যেগুলো পুরান ঢাকার মানুষদের কাছে এক অমুল্য সম্পদ। শুধু শাঁখারীবাজার নয়, পুরান ঢাকায় এমন আরও অনেক জায়গা আছে, যেগুলো যুগের পর যুগ ধরে পুরান ঢাকার ঐতিহ্য এবং পরিচিতি বহন করে চলেছে। উল্লেখ্য, পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার বাংলাদেশ সরকার দ্বারা “হেরিটেজ এলাকা”  হিসেবে ঘোষিত হয়েছে এবং প্রত্নতত্ব বিভাগের কাছে এলাকাটি সংরক্ষনের জন্য হস্তান্তর করা হয়েছে। 

 

ফাতেমা নজরুল স্নেহা

Add comment