Porjotonlipi

হেমনগর জমিদার বাড়ি

হেমনগর জমিদার বাড়ি এর মত পৃথিবীর প্রতিটি দেশের আনাচে কানাচে বেশ কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন পাওয়া যাবে, যা ঐ দেশের ইতিহাসের সাক্ষী বহন করে। ঠিক তেমনি, এই দেশের জমিদার বাড়িগুলো ভারতীয় উপমহাদেশের মুঘলদের শাসনামল থেকে ইংরেজ শাসনামলের জমিদারি প্রথার সাক্ষ্য বহন করে। 

ঐতিহাসিক হেমনগর জমিদার বাড়ি

জমিদার বাড়ি বাংলাদেশের এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন, যা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে রয়েছে। এই দেশে ২৩৯ টিরও বেশি জমিদার বাড়ি রয়েছে।

তবে ভ্রমণপিপাসুদের জন্য যে ক’টি দর্শনীয় জমিদারবাড়ি রয়েছে তার মধ্যে হেমনগর জমিদার বাড়ির আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট হওয়ার সকল গুণ রয়েছে।

হেমনগর জমিদার বাড়ি এর অবস্থান

দর্শনীয় স্থাপনাটি বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুরের শিমলাপাড়া মৌজায় (বর্তমানে হেমনগর) অবস্থিত। গোপালপুর উপজেলা সদর হতে প্রায় ১৫ কি. মি. পশ্চিমে প্রাকৃতিক শোভামন্ডিত ছায়া সুনিবিড় গ্রাম হেমনগর, যা উপজেলার একটি ইউনিয়ন ও ঐতিহাসিক স্থান। অষ্টাদশ শতাব্দীর কারুকাজ করা হেমবাবুর জমিদার বাড়ীটি আজও সেই পুরোনো ঐতিহ্য নিয়ে মাথা উচু করে সগর্বে দম্ভ প্রকাশ করছে।

ইতিহাস

বাংলাদেশের জমিদার বাড়িগুলো বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। দেশের ইতিহাস বিনির্মাণে এই জমিদারবাড়িগুলো আজও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রত্নতাত্ত্বিক এই নিদর্শনের ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রায় ১২৪ বছর আগে পুখুরিয়া পরগণার প্রভাবশালী জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরী অনিন্দ সৌন্দর্যমন্ডিত এই বাড়িটি তৈরি করেন। তিনি ছিলেন মধুপুর উপজেলার আমবাড়ীয়ার জমিদারের উত্তরসূরি। হেমচন্দ্রের দাদা পদ্মলোচন রায় ব্রিটিশ সূ্যাস্ত আইনের মাধ্যমে আমবাড়ীয়ার য়ার জমিদার দখল করেন। ১৮৮০ সালে হেমচন্দ্র তার আমবাড়ীয়ার জমিদার স্থানান্তরিত করে সুবর্ণখালিতে নির্মাণ করেন এক রাজবাড়ী। জমিদারি পরিচালনার ক্ষেত্রে দূরত্ব এবং দশ বছরের মাথায় এ রাজবাড়ী যমুনা গর্ভে নিমজ্জিত হওয়ায়, তিনি তার জমিদারি সুবর্ণখালি থেকে তিন কিলো পূর্ব-দক্ষিণে শিমলাপাড়া মৌজায় ১৮৯০ সালে একটি নতুন দ্বিতল রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন, যা বর্তমানে জমিদার বাড়ি হিসেবে খ্যাত। ১৯৭১ সালে হেমনগর পরী দালান ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাটি। এখান থেকেই কাদেরিয়া বাহিনীর যোদ্ধারা পাকিস্তানী হানাদার ও বর্বর বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

পরীর দালান

অনিন্দ্য সুন্দর জমিদার বাড়িটির অন্য নাম পরীর দালান। রাজবাড়ির উপর নির্মিত দুইটি রাজসিক পরীর ভাস্কর্যের কারণেই মূলত এই দালানের নাম হয় এঞ্জেল হাউজ বা পরীর দালান। যখন থেকে রাজবাড়ীটি নির্মিত হয়েছে ঠিক তখন থেকে লোকমুখে রাজবাড়ির নামটি পরীর দালান হিসেবে প্রচলিত। 

স্থাপনাশৈলী

দিল্লি ও কলকাতার কারিগর দ্বারা তৈরি সুন্দর কারুকার্যমণ্ডিত হেমনগর জমিদার বাড়ি। এর জ্যামিতিকএবং ফ্লোরাল নকশা আগত দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। সুপরিচিত দালানের মোট জমির পরিমাণ প্রায় ৩০ একর মতান্তরে  ৬০ একর উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বিতল জমিদারবাড়িটি তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথম অংশে দ্বিতলা দরবার হল। আর তার পেছনে অন্দর মহল। অন্দর মহলের দুটো অংশ, দুটোই এক তলা।বাড়ির সামনে রয়েছে মাঠ যা পেরোলেই জমিদার হেমচন্দ্রের দরবার ঘর। জমিদার বাড়ির মাঠের সামনে এবং বাড়ির পেছনে রয়েছে বড় দুটি পুকুর। স্থাপনাটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো, এর চিনি টিকরী অলংকরণ, যার মাধ্যমে পদ্ধতিতে স্থাপত্যের গায়ে চিনামাটির বাসন কোসনের ছোট ভগ্নাংশ ও কাঁচের টুকরা ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরণের নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়। চিনি টিকরীর কাজে রঙিন কাচের ব্যবহারের বিষয়টি নজরকাঁড়া। এমনকি এর পিলারগুলোতে ও সাদা কালো রঙের ফ্লোরাল চিনি টিকরীর কারুকার্য দেখতে পাওয়া যায়।জমিদার বাড়ির আশেপাশে আরো ৭টি সুরম্য ভবন আছে যেগুলো জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরীর তিন বোন ও চার ছেলেমেয়ের বাড়ি। আর এই এঞ্জেল হাউজের ভেতরে বিশাল বড় একটা শানবাধানো পুকুর আর দশটি কুয়ো আছে। 

জমিদার বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা হেমচন্দ্র 

হেমচন্দ্র চৌধুরীর তিন বোনসহ সভ্রান্ত পরিবারের সবাই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত এবং মার্জিত রুচির পরিচায়ক। তাদের উন্নত সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল নিয়ে পুরো পূর্ব বঙ্গ জুড়ে সুনাম ছিল। হেমচন্দ্রের পরিবারে এক ডজন সদস্য ছিলেন ব্রিটিশ প্রশাসণের আই.সি.এস কর্মকর্তা। জমিদার বাড়র প্রতিষ্ঠাতা হেমচন্দ্র নিজেও কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজে আইন বিষয়ে পড়ালেখা লেখা করেছেন। আর তার নামানুসারে গ্রামের নাম রাখা হয় হেমনগর। হেমচন্দ্র তাঁর বাবার মৃত্যুর পর জমিদারীর দায়িত্ব পেলেন এবং তিনি তা বিস্তৃত করলেন। টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ মিলিয়ে তাঁর জমিদারীর এলাকা ৪ লক্ষ একরে পরিণত হয়েছিল। তার নাম পরিবর্তিত হয়ে বনে গেলো হেমচন্দ্র চৌধুরী। জমিদার বাড়ির পাশাপাশি তিনি আরোও দু’টি বিষয়ের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। প্রথমত, তিনি জমিদার হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্যসেবা এবং যোগাযোগ খাতে বিভিন্ন স্থাপনা প্রতিষ্ঠার জন্য জমি ও অর্থ প্রদান করতেন। তার দানকৃত জমিতে গড়ে উঠে বিভিন্ন স্কুল।

দ্বিতীয়ত, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা বাতিল হওয়ার পর অত্যাচারী নিয়মগুলি বহাল রাখার জন্য কলকাতা আদালতের সাধারণ প্রজারা ক্ষিপ্ত হলে প্রাণভয়ে তিনি পালিয়ে যান কলকাতায়। হেমনগরে আর কখনই ফেরেননি। ১৯১৫ সালে ভারতের ব্যানারসে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

জমিদার বাড়ির বর্তমান অবস্থা

হেমচন্দ্র যদিও অত্যন্ত সুন্দর এক রাজবাড়ি তৈরি করেছিলেন। কিন্তু তার পরবর্তী প্রজন্মের কেউই জমিদারবাড়ি দেখাশোনার জন্যে বেঁচে নেই। ১৯৪৭ সালের পর সকলেই ভারতে চলে যান। পরবর্তীতে স্বাধীনতার পর ১৯৭৫-৭৬ সালে স্থানীয় একশ’ ১১ জন কৃষক ‘শিমলাপাড়া ভূমিহীন কৃষক সমবায় সমিতি’ নামের একটি সংগঠন করে বাড়ীটির নিয়ন্ত্রন করে।

স্থানীয় মহল জমিদার বাড়ীটিকে কলেজের জন্য উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্ধারণ করলে ১৯৭৯ সালে ‘হেমনগর খন্দকার আসাদুজ্জামান ডিগ্রী কলেজ’ নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়। বাড়িটি কলেজের অধীনে থাকলেও বহু বছর ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে না। তবে বাড়ীটি বেদখল হয়ে যায়নি। হেমচন্দ্রের বংশধর কমল গাঙ্গুলীর কন্যা নন্দিত সঙ্গীত শিল্পী ড. পৌলমী গাঙ্গুলী ২০১৮ সালে পুর্বপুরুষের ভিটেমাটি দেখার জন্য সম্প্রতি কলকাতা থেকে হেমনগরে আসেন। 

কিভাবে যাবেন হেমনগর জমিদার বাড়ি

ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলে আপনি বাসে করে সড়কপথে অথবা ট্রেনে করে পৌছাতে পারবেন। টাঙ্গাইল থেকে প্রায় ২০০/- টাকা ভাড়ায় আপনি সিএনজি অটোরিকশায় করে হেমনগরে পৌঁছে যাবেন। এছাড়া ঢাকার মহাখালি বাস টার্মিনাল থেকে সরাসরি বাসে আপনি গোপালপুর অথবা ভুয়াপুর থানায় পৌছাতে পারবেন। সেখান থেকে সিএনজি অটোরিকশায় করে জমিদারবাড়িতে পৌঁছে যাবেন।

বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো দেশের গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসকে বহন করে। তাই নিদর্শনগুলো পরিচর্যা করা নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ এবং এই দেশের প্রতিটি জনগণের দায়িত্ব। বাংলাদেশের যে ক’টি জমিদার দালান রয়েছে তার মধ্যে খুব ভালো অবস্থায় আছে হেমনগর জমিদারবাড়িটি। জমিদারবাড়িটি ডিগ্রী কলেজের তত্ত্বাবধানে থাকায় বহু কালের পুরনো ইতিহাস নির্বিচারে ধ্বংসের হাত থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পেয়েছে। উপমহাদেশের বেশিরভাগ স্থাপনাই তার স্থাপত্যশৈলীর কারণে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই স্থাপনাগুলো বিলীন হওয়ার পূর্বে, সেগুলোর ইতিহাস সংরক্ষণ করা, জনসাধারণের কাছে সরবরাহ করা এবং তা নিজ স্বচক্ষে দেখে আসা, আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব। আসুন ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো সংরক্ষণ করি এবং পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখি।

 

 

ফারহাত ইসলাম

Add comment