Porjotonlipi

রোমাঞ্চকর হামহাম জলপ্রপাত

বন্ধুরা আজ আমরা আপনাদের নিয়ে যাব হামহাম জলপ্রপাত এর পাদদেশে। হামহামের অবস্থান মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্ট। তবে হামহাম যাবার পথে খুব সতর্ক থাকতে হবে। কেননা হামহাম যাবার পথ বেশ দুর্গম এবং বর্ষায় এই পথের মাটি বেশ আঠালো। আর এই এলাকা জোকের অভয়ারণ্য বলতে পারেন। তবে হামহামের রূপের কাছে এই সকল কষ্ট এক মুহূর্তেই হার মানবে।

দেখুন নয়নাভিরাম হামহাম জলপ্রপাত

ঝরনার যৌবন হল বর্ষাকাল। ঝরনার ঝরে পরা পানি জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ঝিরি পথ তৈরি করে বয়ে চলেছে। এইরকম বিভিন্ন ছোট বড় ঝিরি পথ পেরিয়ে জঙ্গলের পথ পেরিয়ে ঝরনার কাছে পৌঁছাতে হয়। ঝরনায় যেতে হলে কুড়মা বন বিটের চাম্পারায় চা বাগান হয়ে যেতে হয়। চম্পারায় চা বাগান হতে ঝরনার দূরত্ব প্রায় ৭ কিলোমিটার। পথে অত্যন্ত খাড়া মোকাম টিলা পাড়ি দিতে হয় এবং অনেক ঝিরি পথ কাদামাটি দিয়ে পথ চলতে হয়। ঝিরি পথে কোথাও কোথাও চোরাবালিও তৈরি হয়, কিন্তু সেসকল স্থানে পর্যটকদের জন্য কোন নির্দেশিকা দেখা যায় না, সুতরাং আপনার নিজেকেই যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। এছাড়া গভীর জঙ্গলে বানর, সাপ, মশা এবং জোঁকের অত্যাচার সহ্য করে পথ চলতে হয়। বর্ষাকালে হামহামে যাবার কিছু আগে পথে দেখা পাওয়া যায় আরেকটি অনুচ্চ ছোট ঝরনার। হামহামের রয়েছে দুটো ধাপ, সর্বচ্চো ধাপটি থেকে পানি গড়িয়ে পরছে মাঝখানের ধাপে এবং সেখান থেকে আবার পানি পরছে নিচের খাদে। 

পাহাড় অরণ্য ঘেরা মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত এই জলপ্রপাতটি এডভেঞ্চার প্রিয় পর্যটকদের জন্য এটি হল অন্যতম স্থান।

Hamham

হামহাম জলপ্রপাত এর নামের ইতিহাস 

এই জলপ্রপাতটিকে হামহাম বা চিতা ঝরনা বলা হয়। এর নামকরণ সম্পর্কে তাই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মতবাদ আছে। অনেকেই ঝরনার সাথে গোসলের সম্পর্ক করে “হাম্মাম” বা গোসলখানা শব্দটি থেকে “হাম হাম” হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেন। আবার সিলেটি উপভাষায় ” আ-ম আ-ম” বলে বোঝান হয় পানির তীব্র শব্দ, আর ঝরনা যেহেতু সেরকম শব্দ করে, তাই সেখান থেকেই শহুরে পর্যটকদের ভাষায় তা হামহাম বলে প্রসিদ্ধ লাভ করে। 

Hamham3

অ্যাডভেঞ্চার ও হামহাম জলপ্রপাত

কমলগঞ্জের একেবারে শেষ গ্রামের নাম কলাবনপাড়া, যেটি তৈলংবাড়ি নামেও পরিচিত। বলতে গেলে এরপর থেকেই আর কোন জনবসতি নেই। আর এখান থেকেই শুরু হয় হামহাম যাওয়ার আসল অ্যাডভেঞ্চার। হামহাম যাওয়ার জন্য বনের ভিতরে দুটি পথ আছে। বনের শুরুতেই হাতের ডানে এবং বামে পাশাপাশি পথ দুটি। একটা দিয়ে যেতে হবে আরেকটা দিয়ে আসবেন। ডানের পথ দিয়ে ঢুকে বাম দিয়ে বের বের হবেন। এই ব্যবস্থাটি খুবই ভাল, কারণ ডানের পথটা দীর্ঘ এবং অনেক উঁচু টিলা ডিঙ্গাতে হয় যা ফেরার পথে পরলে খুবই কষ্ট হবে। হামহাম যাবার জন্য সাথে একজন গাইড নিয়ে যাওয়া অত্যাবশ্যক, কারণ যারা প্রথম বার যায় তাদের রাস্তা ভুল হওয়াটা স্বাভাবিক। এছাড়া ভ্রমণের সময় পাহাড়ি পথে হাঁটার সুবিধার্থে এবং আত্মরক্ষার জন্য প্রত্যেকের সাথে বাঁশ নেয়া আবশ্যক। এছাড়া জোঁকের হাত থেকে রক্ষা পেতে সাথে করে লবণ ও সরিষার তেল নিয়ে নিলে ভাল। জারুল, চিকরাশি ও কদম গাছের ফাঁকে ফাঁকে রঙিন দানা মেলে দেয় হাজারো প্রজাপতি। চশমা বানরের আনাগোনা ডুমুর গাছের শাখায় চারদিকে গাছগাছালি ও প্রাকৃতিক বাঁশবনে ভরপুর এ বনাঞ্চল। ডলু, মুলি, মিটিংগা, কালি ইত্যাদি অদ্ভুত নামের বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ এ বাগানগুলোকে দিয়েছে ভিন্ন এক রূপ। পাথুরে পাহাড়ের ঝিরি পথে হেঁটে যেতে যেতে সুমধুর পাখির কলরব মনকে ভাললাগার অনুভূতিতে ভরিয়ে দিবে। দূর থেকে কানে ভেসে আসবে বিপন্ন বন মানুষের ডাক। কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর শুরুতে আপনার দুচোখের সামনে ভেসে উঠবে পাহাড় থেকে ধোঁয়ার মতো ঘন কুয়াশা ভেসে উঠার অপূর্ব দৃশ্য। এভাবেই হাঁটতে হাঁটতে একসময় জলপ্রপাতের কাছাকাছি চলে যাবেন আর কিছু দূর গেলেই শুনতে পাবেন হামহাম জলপ্রপাতের শব্দ। ওখানে গেলে আপনার ইচ্ছে হবে না চোখ সরাতে। মনে হবে অনন্তকাল দুচোখ ভরে দেখে নেই প্রকৃতির এই অপূর্ব সৃষ্টি। এই অদ্ভুত এক রোমাঞ্চকর পরিবেশে আপনি ভুলে যাবেন আপনি কোথায় আছেন, চারদিকে গহীন জঙ্গল, উপরে আকাশ, পায়ের নিচে বয়ে যাওয়া ঝির ঝির স্বচ্ছ পানির ধারা আর সামনে বহমান অপরূপ ঝর্না। বুনো পাহাড়ের ১৫০ ফুট উপর হতে গড়িয়ে পরা স্রোতধারা কলকল শব্দ করে এগিয়ে যাচ্ছে পাথরের পর পাথর কেটে সামনের দিকে তার গন্তব্য।

Hamham2

 

কিভাবে যাওয়া যায় হামহাম জলপ্রপাত 

ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল যেতে হবে। ঢাকা থেকে রেল ও সড়ক পথে শ্রীমঙ্গল যাওয়া যায়। ঢাকার কমলাপুর থেকে মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৬ টা ৪০ মিনিটে ছেড়ে যাওয়া আন্তঃনগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস। বুধবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন রাত ১০ টায় ছাড়ে উপবন এক্সপ্রেস। ভাড়া ১১৫ টাকা থেকে ৭৬৫ টাকা। 

 ঢাকার সায়দাবাদ, কমলাপুর, আরামবাগ থেকে হানিফ, শ্যামলী, মামুন, ইউনিক ইত্যাদি পরিবহনে অথবা কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে সিলেতগামী ট্রেনে করে শ্রীমঙ্গল এসে নামতে হবে। 

শ্রীমঙ্গল নেমে হোটেল নিয়ে নিলে ভাল করবেন। যদি রাতের গাড়িতে আসেন তবে শ্রীমঙ্গল থেকে নাস্তা করে ৯ টার মধ্যে রওনা দিবেন। আর যদি দিনের গাড়িতে রওনা হন তবে রাতে হোটেলে থেকে ভোরে হামহাম ঝর্না চলে যাবেন এবং পথে কুরমা বাজারে নাস্তা সেরে নিবেন। শ্রীমঙ্গল হোটেলের আশেপাশে অনেক সিএনজি পাবেন, আপনাকে শ্রীমঙ্গল থেকে যেতে হবে কলাবন পাড়া, ওদের হামহাম যাব বললেই হবে। 

কোথায় থাকবেন 

শ্রীমঙ্গলে থাকার জন্য সবচেয়ে ভাল মানের জায়গা ভানুগাছ সড়কে টি-রিসোর্ট। অন্যান্য থাকার জায়গার মধ্যে আছে, হোটেল গ্র্যান্ড সুলতান, রেইন ফরেস্ট রিসোর্ট, টি টাউন রেস্ট হাউস, হোটেল প্লাজা, বি টি আর আই ইত্যাদি। এছাড়া শ্রীমঙ্গলে রাধানগরে চমৎকার দুটি রিসোর্ট হল নিসর্গ নীরব ইকো রিসোর্ট এবং নিসর্গ লিচিবাড়ী ইকো রিসোর্ট।এছাড়াও কমদামী কিছু হোটেলও আছে। তবে হামহাম ঝর্না এলাকার আশেপাশে থাকার মতো তেমন ভাল ব্যবস্থা নেই। তবে নিজেকে যদি মানিয়ে নিতে পারেন তাহলে তৈলংবাড়ি কিংবা কলাবন পাড়াতে আদিবাসীদের ঘরে থাকতে পারেন। 

পুনঃশ্চ সাবধানতা

১. যাওয়ার আগে অবশ্যই কলাবনপাড়ার স্থানীয়দের কাছ থেকে ভালো-মন্দ জেনে যাওয়া উচিৎ। সঙ্গে সরিষার তেল আর লবণ রাখতে হবে। কেননা প্রচুর জোঁকের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে এই দুটি ব্যবস্থাই কার্যকরী।

২. হাতে একটা ছোট বাঁশের টুকরা বা লাঠি সঙ্গে নেওয়া ভালো। এতে পাহাড়ি পথে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করা থেকে শুরু করে সাপ বা অন্যান্য বন্যপ্রাণী থেকে নিরাপদ রাখবে।
৩. সঙ্গে শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানি আর খাবার স্যালাইন রাখতে ভুলবেন না। জীবাণুনাশক ক্রিম আর তুলা সঙ্গে নেবেন। আর খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হবে। অবশ্যই গাইড নিয়ে যাওয়া উচিত।

কন্টেন্ট রাইটার- দেবযানী দত্ত

 

Porjotonlipi Desk

1 comment

  • ?এখন ভালোই বৃষ্টি হচ্ছে চাইলেই ঘুরে আসতে পারেনl
    হামহাম ঝর্ণা

    ??‍♂️মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গভীরে ২০১০ সালের শেষের দিকে পর্যটন গাইড শ্যামল দেববর্মাকে সাথে নিয় একদল পর্যটক হাম হামের এই অনিন্দ্য জলপ্রপাতটি আবিষ্কার করেন। স্থানীয়দের কাছে এই ঝর্ণা চিতা ঝর্ণা হিসাবে পরিচিত, তাদের মতে এই জঙ্গলে আগে চিতা পাওয়া যেত। প্রায় ১৪০ফিট উঁচু এই ঝর্ণার বুনো সৌন্দর্য দেখার জন্যে অনেক কষ্ট স্বীকার করে সমগ্র বাংলাদেশ থেকে মানুষ ছুটে আসে। শীতকালে তুলনামূলক পানি কিছটাু কম থাকলেও কিন্তু বর্ষাকালে কালে হাম হামের বুনো সৌন্দর্য্য দেখার উপযুক্ত সময়।

    ✅হামহাম লোকাল গাইড সাজ্জাদ 01717760509