Porjotonlipi

সোমপুর মহাবিহার – উত্তরাঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য

সোমপুর মহাবিহার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের একটি প্রাচীন উপাসনালয়, যেটি বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার পাহাড়পুর এলাকায় রয়েছে। পাহাড়পুর এলাকায় অবস্থানের কারনেই অনেকে একে পাহাড়পুর বিহার  নামেও চিনেন।  

বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান খেতাবপ্রাপ্ত সোমপুর মহাবিহার 

১৯৮৫ সালে এই সোমপুর বৌদ্ধ মহাবিহার ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান  এর তালিকাভুক্ত হয়। ইউনেস্কো এর ভাষ্যমতে এই সোমপুর মহাবিহার দক্ষিণ হিমালয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাবিহার , যেটির আয়তম ভারতের নালন্দা মহাবিহার  এর সমতুল্য। এই বৌদ্ধবিহার নির্মাণের ৩০০ বছর পর্যন্ত এটি একটি শিক্ষাদান প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হত, যেখানে উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানের পাশাপাশি চীন, মায়ানমার, তিব্বত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ হতে অনেক বৌদ্ধ ধর্মানুসারীগণ এখানে জ্ঞান অর্জন করার লক্ষ্যে আসতেন। 

খ্রিস্টীয় দশম শতকে এই মহাবিহারের আচার্য ছিলেন অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। 

ইতিহাস ও অবস্থান 

প্রাচীন যুগে এই বঙ্গদেশ একটি খণ্ড রাষ্ট্র ছিল, যেখানে গৌড়, পুণ্ড্র, সমতট, হরিকেল, বরেন্দ্র সহ ১৬ টি জনপদ ছিল। নওগাঁ তখন ছিল পুণ্ড্রবর্ধন জনপদের অন্তর্ভুক্ত। এই ১৬ টি জনপদ নিয়ন্ত্রন করার জন্য অনেক বংশ হতে অনেক রাজা এসেছিলেন। তাঁদের একজন ছিলেন পাল বংশ এর দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপাল দেব, যিনি আনুমানিক অষ্টম শতকের শেষে এবং নবম শতকের শুরুতে এই বৌদ্ধবিহার নির্মাণ করান। পাল সম্রাটগণ বৌদ্ধধর্মের মহাযান এবং তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের অনুগামী ছিলেন। তাঁরা ছিলেন ধ্রুপদি ভারতীয় দর্শন, সাহিত্য, চিত্রকলা, এবং ভাস্কর্যশিল্পের বিশিষ্ট প্রশংসক। সেই সুবাদে তাঁরা একাধিক বিশালাকার উপাসনালয় নির্মাণ করিয়েছিলেন। সোমপুর মহাবিহার তার মধ্যে অন্যতম। পরবর্তীতে ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম এই বিশালাকার স্থাপনার আবিষ্কার করেন। 

বর্তমানে বৃহত্তর রাজশাহী’র অন্তর্গত নওগাঁ জেলায় এই মহাবিহারের বিশালাকার ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। সমস্ত জায়গাটি চতুর্ভুজ আকৃতির, এবং এই জায়গার মাটিতে লৌহ পদার্থের উল্লেখযোগ্য পরিমাণে থাকার কারণে এই জায়গার মাটি লাল বর্ণের। যদিও বর্তমানে মাটিতে পলিমাটির আবরণের কারণে লাল বর্ণ ঢাকা পড়েছে। বিহারের আশেপাশের জায়গা বেশ নিচু হওয়ার কারণে এই বিহারটি একটি পাহাড়সদৃশ রূপ ধারণ করেছে। একসময়ে সেখানকার স্থানীয়রা এই বিহারকে গোপাল চিতার পাহাড়  নামে সম্বোধন করত, যে কারণে এটির নাম হয়ে যায় পাহাড়পুর, কিন্তু এই বিহারের প্রকৃত নাম সোমপুর বিহার  অথবা সোমপুর মহাবিহার ।  

কি কি আছে সোমপুর মহাবিহার এর ধ্বংসাবশেষে ? 

চতুষ্কোণ বিহারের চারপাশ চওড়া দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল। বিহারে প্রায় ১০০ টির মত কক্ষ ছিল, যেখানে একসময়ে ভিক্ষুরা অবস্থান করত, এবং পরে কয়েকটি কক্ষ উপাসনা ঘরে রুপান্তর করা হয়। 

বিহারের উনুক্ত চত্বরের মাঝ বরাবর রয়েছে কেন্দ্রীয় বৌদ্ধমন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। মন্দির ঘিরে রয়েছে কিছু কক্ষ এবং মণ্ডপ। উন্মুক্ত স্থানে রয়েছে আরও কিছু ইমারত, যেগুলো কিরকম ছিল, সেই বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়নি। ইমারতগুলোর একপাশে আছে রন্ধনঘর, ভোজনশালা। এই দুই ঘরের মাঝে রয়েছে একটি নর্দমা। এই দুই ভবন থেকে কিছুটা দূরে রয়েছে কিছু প্রশাসনিক ভবন, নিবেদন স্তূপ, কেন্দ্রীয় মন্দিরের প্রতিকৃতি ইত্যাদি। 

বিহারের দক্ষিণ দিক থেকে ২৭ মিটার দক্ষিনে বেশকিছু স্নানাগার এবং শৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছিল। 

আরও ছিল একটি স্নানঘাট, যেটি সমতল থেকে ১২ মিটার নেমে গিয়েছে। ঘাটের উপরে ছিল বালুর পুরু স্তর, যেখান থেকে অনুমান করা হয় এই ঘাটের সাথে নদীর সংযোগ ছিল। স্নানঘাট থেকে ১২ মিটার পশ্চিমে একটি ইমারত পাওয়া গিয়েছে জেতাকে স্থানীয়ভাবে গন্ধেশ্বরী মন্দির  বলা হয়। 

সোমপুর বিহার থেকে বেশ কিছু পুরাকীর্তি এবং মূর্তি পাওয়া গিয়েছে যেগুলো বর্তমানে সংরক্ষিত অবস্থায় আছে। এছাড়াও বিহারের দেয়ালে পোড়ামাটির শিল্পকর্ম খণ্ডায়িত আছে। 

 

ফাতেমা নজরুল স্নেহা

Add comment