সুচিত্রা সেন , এই নামটা শোনেননি এমন মানুষ এই বাংলায় খুঁজে পাওয়া দায়। যিনি তার রূপ-গুন আর অভিনয় দক্ষতা দিয়ে কোটি-কোটি বাঙ্গালীর মন জয় করে নিয়েছেন খুব সহজেই।
কবি রজনীকান্ত সেনের নাতনী, মহানায়িকা সুচিত্রা সেন ওপার বাংলার মানুষ হিসেবে পরিচিত হলেও তার পৈত্রিক নিবাস কিন্তু এই বাংলাদেশেই।
সুচিত্রা সেন, একজন মহানায়িকা
সুচিত্রা সেন ১৯৩১ সালের ৬ই এপ্রিল পাবনা জেলার দুলালপুর ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামের হেমসাগর লেনে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পর তার নাম রাখা হয় রমা দাসগুপ্ত। কৈশোর পর্যন্ত পাবনা জেলা শহরেই থাকেন তিনি। সেখানেই তার স্কুল জীবন কাটে। তার বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত ছিলেন পাবনা পৌরসভার স্যানিটারি ইন্সপেক্টর ও মা ইন্দিরা দেবী ছিলেন গৃহবধূ। তিনি ছিলেন পরিবারের পঞ্চম সন্তান ও তৃতীয় কন্যা।
সুচিত্রা সেন ও পাবনা জেলা
পাবনাতেই তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষা শুরু হয়। পাবনার মহাখালি পাঠশালায় প্রাইমারি শিক্ষা শেষ করে দশম শ্রেণী পর্যন্ত উনি পড়াশুনা করেন পাবনা গার্লস স্কুলে। এর পর তার আর পড়াশোনা হয়েছে বলে জানা যায়নি। পাবনা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেনীতে পড়া কালীন সময়ে ১৯৪৬ সালের ১৫ আগষ্ট পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারনে সুচিত্রা সেনের পরিবার বসতভিটা রেখে কলকাতায় পাড়ি জমান।
রমা দাসগুপ্ত থেকে মহা নায়িকা- সুচিত্রা সেন:
১৯৪৭ সালের দিকে মাত্র ১৬ বছর বয়সে রমা দাসগুপ্তের বিয়ে হয় কলকাতার বিশিষ্ট শিল্পপতি আদিনাথ সেনের ছেলে দীবানাথ সেনের সঙ্গে। রমা দাসগুপ্ত ১৯৫২ সালে সুচিত্রা সেন নাম নিয়ে বাংলা চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৫২ সালে ‘শেষ কোথায়’ ছবির মাধ্যমে তার চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু ছবিটি মুক্তি পায়নি।
সুচিত্রা সেনই বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম অভিনেত্রী, যিনি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব থেকে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। ‘সাত পাকে বাঁধা’ ছবিতে অনবদ্য অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৬৩ সালে মস্কো চলচ্চিত্র উৎসব থেকে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান তিনি। ১৯৫৫ সালের দেবদাস ছবির জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জেতেন, যা ছিল তার প্রথম হিন্দি ছবি। উত্তম কুমারের সাথে বাংলা ছবিতে রোমান্টিকতা সৃষ্টি করার জন্য তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বিখ্যাত অভিনেত্রী।
পাবনার ঐতিহাসিক সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংগ্রহশালা
এবার পাবনা শহরে বেড়াতে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল একটাই, সুচিত্রা সেনের বাড়ি ঘুরে দেখা। মহানায়িকা সুচিত্রা সেনকে নিয়ে অনেক লেখায় পড়েছি এই বাড়ির গল্প। পাবনা শহরে পা দিয়ে তাই প্রথমেই ছুটলাম গোপালপুরের উদ্দেশ্যে। এই এলাকার হেমসাগর লেনেই রয়েছে সুচিত্রা সেনের ছেলেবেলার স্মৃতি বিজড়িত পৈত্রিক বসতবাড়ি।
পাবনা টেকনিক্যাল কলেজের বিপরিতের সাদা রঙের একটি বাড়ি, সামনে সবুজ রঙের একটি লোহার দরজা, দরজার উপরে সুচিত্রা সেনের ছবি সম্বলিত একটি ব্যানার। মূল প্রবেশদ্বারে রয়েছে একটি কাউন্টার। যেখান থেকে ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কাটার পরেই মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের পৈতৃক ভিটা-বাড়িতে ঢোকা যাবে। ১০ টাকার টিকিট কেটে পার হলাম বাড়ির মূল ফটক। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়লো দৃষ্টিনন্দন বাহারি সব ফুলের গাছ। বাড়ির আঙিনায় স্থাপন করা হয়েছে মহানায়িকার একটি আবক্ষ ভাস্কর্য। প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে বিশালাকৃতির এ প্রতিকৃতি।
সুচিত্রা সেন সম্পর্কে জানাতে ও তার স্মৃতি রক্ষার্থে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গড়ে তোলা সংগ্রহশালায় মহানায়িকার বিভিন্ন ছবি, জীবনের বিভিন্ন তথ্য সম্বলিত বিলবোর্ড, বই, সিনেমার পোস্টারসহ রয়েছে নানা নিদর্শন।
বিরাট উঠান পার হয়ে সিঁড়ি বারান্দা, তারপরই রয়েছে মূল ঘরগুলো। ঘরে পা দিতেই মোহিত হতে হবে সুচিত্রা সেনের সিনেমার গানের সুরে। ঘরগুলোর দেয়ালজুড়ে ছোট–বড় ফ্রেমে সাজানো সুচিত্রা সেনের ছবি। কোনো ছবিতে ধরা পড়েছে তাঁর নায়িকা হওয়ার মুহূর্ত, আবার কোনো ছবিতে রয়েছেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা। আরও আছে সুচিত্রা সেনের পছন্দ-অপছন্দ এবং নানা অজানা বিষয় নিয়ে লেখা ফেস্টুন। পটভূমিতে বেজে যাচ্ছে একটার পর একটা সুচিত্রা সেন অভিনীত সিনেমার গান।
শৈশব ও কৈশোরের অনেকটা সময় সুচিত্রা সেন কাটিয়েছেন এই বাড়িতে। পুরো বাড়িজুড়ে ছড়িয়ে আছে তার অসংখ্য স্মৃতিচিহ্ন। একটা দেয়ালের ফেস্টুনে লেখা আছে ঘর সাজানোর প্রতি সুচিত্রা সেনের বিশেষ দুর্বলতার কথা। এই বাড়ির কোথাও এখন সুচিত্রা সেনের নিজ হাতে সাজানোর কোনো ছোঁয়া নেই। তবে এর প্রতিটি কোণেই সুচিত্রা সেনের বেড়ে ওঠা, শৈশবের দাঁপিয়ে বেড়ানোর যে ছোঁয়া আছে, তাই বা কম কিসে। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টার মধ্যে সবাই এসে ঘুরে যেতে পারবেন এখানে।
সুচিত্রা সেনের অন্তরীণ জীবন
১৯৭৮ সালে সুদীর্ঘ ২৫ বছর অভিনয়ের পর তিনি চলচ্চিত্র থেকে অবসরগ্রহণ করেন। এরপর তিনি লোকচক্ষু থেকে আত্মগোপন করেন এবং রামকৃষ্ণ মিশনের সেবায় ব্রতী হন।
তখন থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক, মেয়ে মুনমুন, মেয়ে জামাই,আর দুই নাতনি রাইমা ও রিয়া ছাড়া আর কেউ তাঁকে দেখেনি। তার স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকার কী কারণ? কী রহস্য? এসব প্রশ্নের উত্তর বহুবার খোঁজার চেষ্টা করেছে প্রচারমাধ্যম। একেক জন একেক ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রকৃত কারণ কখনই জানা যায়নি।
মহানায়িকার মহা প্রয়াণ
অভিনয় ও সৌন্দর্যের জন্য তিন দশক ধরে বাঙালির জননন্দিত এই নায়িকা ৮২ বছর বয়সে ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি ভারতীয় সময় সকাল ৮টা ২৫ মিনিটে কলকাতার বেল ভিউ হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
সোমবার ব্যাতিত সপ্তাহের ছয়দিন বাড়িটি দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। তবে বিশেষ কারণবশত মাঝেমধ্যে সোমবার ছাড়া অন্য দিনও দর্শনার্থী প্রবেশ বন্ধ থাকে। তাই এখানে যাওয়ার পূর্বে 01792100395 নাম্বারে কল করে তা জেনে নিতে পারেন।
কিভাবে যাবেন এবং কোথায় থাকবেন
বাংলাদেশের যেকোন জায়গা থেকে বাস কিংবা ট্রেনে চেপে পাবনা শহরে নেমে অটোরিক্সায় করেই পৌঁছে যেতে পারবেন সুচিত্রা সেনের বাড়িতে। আর থাকার জন্য নিচের লিংকটির মাধ্যমে পাবনা জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে দেয়া হোটেল, মোটেল, রেস্টহাউজসহ বিভিন্ন আবাসিক জায়গা থেকে আপনার পছন্দ অনুযায়ী যোগাযোগ করে নিতে পারবেন নিজেই। ওয়েবসাইটটিতে ঠিকানার পাশাপাশি ফোন নাম্বার এবং ভাড়ার পরিমাণও দেয়া রয়েছে।
Add comment