আজ আমরা আপনাদের সামনে তুলে ধরবো সাজেক ভ্যালি যা এক নৈসর্গিক সৌন্দর্যের স্থান। এই সাজেক ভ্রমন হয়তোবা হতে পারে আপনার স্মরনীয় ভ্রমণগুলোর একটি। সাজেক রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলায় অবস্থিত। সাজেক হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন। যার আয়তন ৭০২ বর্গমাইল।
হালের ক্রেজ সাজেক ভ্যালি
সাজেকের উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা, দক্ষিনে রাঙামাটির লংগদু, পূর্বে ভারতের মিজোরাম, পশ্চিমে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা। যদিও সাজেক ভ্যালি রাঙামাটি জেলায় অবস্থিত, তবে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে সাজেক যাওয়া সহজ। সাজেকে যেন সবুজের বুকে মেঘের রাজত্ব চলে। কথাটি আশ্চর্যজনক হলেও সত্য। বর্ষা মৌসুমে চিরসবুজ সাজেক সাদা মেঘে আচ্ছাদিত থাকে, শীতে নেয় ভিন্ন রূপ। এক কথায় সাজেককে মেঘের বাড়ি বললেও ভুল হবে না। অনেকে আবার সাজেককে বাংলার দার্জিলিং হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে। সবমিলিয়ে সাজেক এক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমির নাম। সৌন্দর্যের এই কুণ্ডুলিতে যাবার ইচ্ছে অনেকেরই। বর্ষা, শরৎ এবং হেমন্ত সাধারণত এই তিন ঋতুতে মেঘের লুকোচুরি দেখতে পর্যটকদের বেশি সমাগম ঘটে।
সাজেক ভ্যালির বিস্তৃতি
খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে সাজেকের দুরত্ব ৭০ কিলোমিটার এবং দীঘিনালা থেকে ৪৯ কিলোমিটার। সেখানে যেতে হলে আপনাকে খাগড়াছড়ি থেকে দীঘিনালা আর্মি ক্যাম্প হয়ে যেতে হবে। এর পর আপনি পেয়ে যাবেন ১০ নং বাঘাইহাট পুলিশ আর্মি ক্যাম্প, মূলত সেখান থেকেই আপনাকে সাজেক যাবার অনুমতি নিতে হবে । তারপর যাত্রা পথে পাবেন কাসালং ব্রিজ, টাইগার টিলা আর্মি পোস্ট ও মাসালং বাজার এবং এই বাজার পার হলে পরবে সাজেকের প্রথম গ্রাম রুইলুই পাড়া যার উচ্চতা ১৮০০ ফুট । এই পাড়ার আদি জনগোষ্ঠী হল লুসাই, এছাড়া এখানে পাংকুয়া ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীরও বসবাস রয়েছে ।
১৮৮৫ সালে এই পাড়া প্রতিষ্ঠিত হয়। রুইলুই পাড়া থেকে অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে যাবেন সাজেক । আপনাদের বলে রাখি সাজেকের বিজিবি ক্যাম্প কিন্তু বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিজিবি ক্যাম্প এবং এখানে হেলিপ্যাডও আছে । সাজেকের শেষ গ্রাম কংলক পাড়া এবং এই পাড়াটিও লুসাই জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত। আপনি এই কংলক পাড়া থেকে ভারতের লুসাই পাহাড় দেখতে পাবেন। যেখান থেকে কর্ণফুলী নদী উৎপন্ন হয়েছে। বলে রাখা ভাল সাজেক বিজিবি ক্যাম্প এর পর আর কোন ক্যাম্প না থাকায় নিরাপত্তা জনিত কারনে কংলাক পাড়ায় মাঝে মাঝে যাওয়ার অনুমতি দেয় না।
যেভাবে যাবেন সাজেক ভ্যালি
খাগড়াছড়ি থেকে চাঁন্দের গাড়ি রিজার্ভ নিয়ে একদিনে সাজেক ভ্যালী ঘুরে আসতে পারবেন। ভাড়া নিবে ৫০০০ – ৬০০০ টাকা। এক গাড়িতে ১৫ জন বসতে পারবেন। লোক কম হলে শহর থেকে সিএনজি নিয়েও যেতে পারবেন। ভাড়া ৩০০০ টাকার মতো নিবে। অথবা খাগড়াছড়ি শহর থেকে দীঘিনালা গিয়ে সাজেক যেতে পারবেন। বাসে দীঘিনালা জন প্রতি ৪৫ টাকা এবং মোটর সাইকেলে জন প্রতি ভাড়া ১০০ টাকা। দীঘিনালা থেকে ১০০০ – ১২০০ টাকায় মোটর সাইকেল রিজার্ভ নিয়েও সাজেক ঘুরে আসতে পারবেন। ফেরার সময় অবশ্যই সন্ধ্যার আগে আপনাকে বাঘাইহাট আর্মি ক্যাম্প পার হতে হবে। তা না হলে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। ভুল করেও কিন্তু ক্যাম্পের ছবি তোলার চেষ্টা করবেন না, কেন না ক্যাম্পের ছবি তোলার কোন অনুমতি নেই।
রাঙামাটি থেকে কাপ্তাই হয়ে নৌপথে এসে বেশখানিকটা পথ পায়ে হেঁটে সাজেক আসা যায়।
থাকার ব্যবস্থা
পর্যটকদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে সাজেক ভ্যালিতে থাকার ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে বেশকিছু রিসোর্ট। যেখানে আপনি নিশ্চিন্তে পরিবার বা বন্ধুদের নিয়ে থাকতে পারবেন। সাজেক ভ্যালির রিসোর্ট-এর রুম ভাড়া, যোগাযোগ ও বুকিং তথ্য এবং সাজেক ভ্রমণ খরচ সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হলো পর্যটকদের সুবিধার্তে।
সাজেক রিসোর্টঃ
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালিত রিসোর্ট সাজেক রিসোর্ট। যার দ্বিতীয় তলায় চারটি কক্ষ আছে। খাবারের ব্যবস্থা আছে। এই আর নন এসি রুম গুলোর ভাড়া ১০,০০০ – ১৫,০০০ টাকা। সেনাবাহিনিতে কর্মরত বা প্রথম শ্রেনীর সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য রয়েছে বিশেষ ছাড়। যোগাযোগ: ০১৮৫৯০২৫৬৯৪ অথবা ০১৮৪৭০৭০৩৯৫।
আলো রিসোর্ট:
এটি সাজেকের একটু আগে রুইলুই পাড়াতে অবস্থিত। এটিতে মোট ৬ টি রুম আছে। ডাবল রুম ৪ টি (প্রতিটিতে ২টি খাট)। কাপল রুম ২ টি। যোগাযোগ: ০১৮৬৩৬০৬৯০৬ অথবা ০৩৭১-৬২০৬৭।
রুন্ময় রিসোর্ট:
এই রিসোর্টে মোট ৫ টি রুম রয়েছে। প্রতিটি কক্ষে ২ জন থাকতে পারবেন। নিচ তলার রুম ভাড়া ৪৪৫০ টাকা। প্রতিটি কক্ষে ২ জন থাকতে পারবেন। ৬০০ টাকা দিয়ে অতিরিক্ত বেড নিতে পারবেন। উপরের তলায় দুজন করে থাকার দুইটি কক্ষ রয়েছে, ভাড়া ৪৯৫০ টাকা। যোগাযোগ: ০১৮৬৫৪৭৬৮৮।
মেঘ মাচাং:
মেঘ মাচাং রিসোর্ট অনেকের পছন্দের শীর্ষে। কারণ, সুন্দর ভিউ ও তুলনামূলক কম খরচে থাকা যায় এখানে। আছে খাবারের ব্যবস্থা। মেঘ মাচাং-এ পাঁচটি কটেজ আছে। ভাড়া ২৫০০-৩৫০০ টাকা। যোগাযোগ: ০১৮২২১৬৮৮৭৭।
লুসাই কটেজ:
কাপল রুম, ডাবল বেডসহ আছে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা। সুন্দর ডেকোরেশন ও ভালো ল্যান্ডস্কেপিক ভিউয়ের এই কটেজের রুমের ভাড়া ২০০০-৩০০০ টাকা। যোগাযোগ: ০১৬৩৪১৯৮০০৫।
মেঘ পুঞ্জি রিসোর্ট:
সুন্দর ইকো সাজসজ্জা ও আকর্ষণীয় ল্যান্ডস্কেপিক ভিউ সহ মেঘপুঞ্জিতে আছে ৪টি কটেজ, প্রতিটিতে ৩-৪ জন থাকা যাবে। ভাড়া ২৫০০-৩৫০০ টাকা। যোগাযোগ: ০১৮১৫৭৬১০৬৫।
ঝিঁ ঝিঁ পোকার বাড়ি:
নামটাই কী অদ্ভুত সুন্দর। ৪ রুমের এই কটেজে রুম প্রতি ভাড়া ২০০০-২৫০০ টাকা। যোগাযোগ: ০১৮৬৯১৫৭৬৬৬।
ম্যাডভেঞ্চার রিসোর্ট:
রিসোর্টটির ল্যান্ডস্কেপিক ভিউ অসাধারণ। কাপল রুম সিঙ্গেল বেড ২০০০ টাকা, ডাবল বেড- ২৫০০ টাকা। যোগাযোগ: ০১৮৮৫৪২৪২৪২।
রুইলুই পাড়া ক্লাব হাউজ:
এটি সাজেকের একটু আগে রুইলুই পাড়াতে অবস্থিত। এখানে ১৫ জনের মত থাকতে পারবেন। ভাড়া জনপ্রতি ১০০-২০০ টাকা করে দিতে হবে। নিজেরা রান্না করে খেতে পারবেন। এর কেয়ার টেকার মইয়া লুসাই দাদা সব ব্যবস্থা করে দিবে। লক্ষন নামেও একজন আছে, প্রয়োজনে আপনাদের সহযোগীতা করবে। এখানে দুইটি টয়লেট আছে। একটি ফ্রি ব্যবহার করতে পারবেন। অন্যটির জন্য ২০০ টাকা প্রদান করতে হবে। যোগাযোগ: ০১৮৬০১০৩৪০২ অথবা ০১৮৩৮৪৯৭৬১২।
আদিবাসী ঘর:
কম খরচে থাকতে চাইলে আদিবাসিদের ঘরেও থাকতে পারবেন। জনপ্রতি ২০০-৩০০ টাকায় থাকা যাবে। ফ্যামিলি বা কাপল থাকার জন্যে আদর্শ না হলেও বন্ধু বান্ধব মিলে একসাথে থাকা যাবে।
উপরে রিসোর্ট এবং কটেজগুলো নিয়মিত ভাড়ার পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে। শুক্র-শনিবার, ঈদ এবং বিভিন্ন বিশেষ ছুটির দিন ইত্যাদি সময়ভেদে ভাড়ার পরিমাণ কমবেশি হতে পারে। আবার অনেক সময় পর্যটকের আনাগোনা কম থাকলে রিসোর্টগুলোতে কিছুটা ছাড়ের সুবিধা পাওয়া যায়। তবে সকলক্ষেত্রে রিসোর্ট বা কটেজ ঠিক করতে একটু দরদাম করে নেয়া ভালো।
ফেরার সময় হাজাছড়া ঝর্ণা, দীঘিনালা ঝুলন্ত ব্রিজ ও দীঘিনালা বনবিহার দেখে আসতে পারেন। একদিনে এই সব গুলো দেখতে হলে যত তারাতারি সম্ভব বেড়িয়ে পড়বেন। আরেকটি মজার বিষয় হল খাগড়াছড়ির সিস্টেম রেস্তোরায় ঐতিহ্যবাহী খাবার খেতে ভুলবেন না কিন্তু।
নৌপথে সাজেক যেতে হলে কতটুকু পথ হাটতে হয়