বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির রাজধানী হিসেবে পরিচিত পশ্চিম বাঙলার সমৃদ্ধ কুষ্টিয়া জেলাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সূর্যোদয়ের দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
বাংলা সংস্কৃতির রাজধানী কুষ্টিয়া জেলা
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত এই কুষ্টিয়া শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বাংলাদেশকে করেছে সমৃদ্ধ। এছাড়াও বিষাদ সিন্ধুর রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেন এবং বাউল সম্রাট লালনের তীর্থভূমি, পুরাতন কুষ্টিয়া হাটশ হরিপুর গ্রামে গীতিকার, সুরকার ও কবি আজিজুর রহমানের বাস্ত্তভিটা ও কবর, এ জনপদে জন্মগ্রহণকারী বিশিষ্ট কবি দাদ আলী, লেখিকা মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, ‘‘এই পদ্মা এই মেঘনা’’ গানের রচয়িতা আবু জাফর, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান, কুষ্টিয়ার সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠাতা কাঙাল হরিণাথ, নীল বিদ্রোহের নেত্রী প্যারী সুন্দরী, স্বদেশী আন্দোলনের নেতা বাঘা যতিন, প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী, সঙ্গীত শিল্পী মোঃ আব্দুল জববার, ফরিদা পারভীন সহ অসংখ্য গুণীজনের পীঠস্থান কুষ্টিয়াকে সমৃদ্ধ করেছে।
আমরা অনেকেই হয়তো ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকার কথা শুনেছি। এই পত্রিকা কাঙাল হরিণাথের ‘এম.এন প্রেস’ থেকেই ছাপা হত। এই প্রেসটি কালের সাক্ষী হিসেবে কুষ্টিয়াতে রয়েছে। তাছাড়া ‘লাঠি খেলা’ গ্রাম বাংলার এক ঐতিহ্যবাহী খেলা। আর এই লাঠিয়াল বাহিনীর কেন্দ্রীয় সদর দপ্তর এই জেলাতেই অবস্থিত। এক কথায় এই জেলাকে বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতির সুতিকাগার বলা যেতে পারে।
নামকরণঃ
কুষ্টিয়ার নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানা কাহিনী। কুষ্টিয়ায় একসময় কোষ্টার (পাট) চাষ হত বলে কোষ্টা শব্দ থেকে কুষ্টিয়া নামকরণ হয়েছে। হেমিলটনের গেজেটিয়ারে উল্লেখ আছে যে স্থানীয় জনগণ একে কুষ্টি বলে ডাকত বলে এর নাম হয়েছে কুষ্টিয়া। অনেকের মতে ফরাসি শব্দ’’ কুশতহ’’ যার অর্থ ছাই দ্বীপ থেকে কুষ্টিয়ার নামকরণ হয়েছে। সম্রাট শাহজাহানের সময় কুষ্টি বন্দরকে কেন্দ্র করে কুষ্টিয়া শহরের উৎপত্তি ঘটেছে।
ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া শহরের দূরত্ব প্রায় ২২৯ কিঃমিঃ। ঢাকার কল্যানপুর এবং গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে কুষ্টিয়াগামী বাস পেয়ে যাবেন। তাছাড়া আপনি চাইলে ঢাকা থেকে খুলনাগামী ট্রেনে চড়ে পোড়াদহ নেমে সেখান থেকেও কুষ্টিয়া যেতে পারেন। গড়াই নদীর তীরে অবস্থিত এই জেলায় আরো দুটি নদী রয়েছে যেগুলো হল কুমার ও কালিগঙ্গা।
পর্যটন কেন্দ্রসমূহঃ
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ
ব্রিটিশ আমলে কুষ্টিয়ার সাথে কলকাতার রেল যোগাযোগ ছিল। ১৯০৯ সালে পদ্মা নদীর উপর ভেড়ামারা-পাকশি রেল সেতু নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ১৯১৫ সালে শেষ হয়। তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ এর নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। ব্রিজটি লম্বায় এক কিলোমিটার এবং এতে ১৮টি স্প্যান আছে। এটি পৃথিবীর অন্যতম বৃহতম রেল সেতু। ১৯৭১ সালে পাকবাহিনীর বোমার আঘাতে এর দুটি স্প্যান নষ্ট হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে পুনরায় তা মেরামত করা হয়। বর্তমানে এর পাশেই লালন শাহ্ সেতুর অবস্থান।
মীর মশাররফ হোসেনের বাস্ত্তভিটা
বিষাদ সিন্ধুর রচয়িতা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক মীর মশাররফ হোসেনের বাস্ত্তভিটা কুমারখালী উপজেলার লাহিনীপাড়ায় অবস্থিত। এখানে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ছোট আকারের একটি লাইব্রেরী আছে। সম্প্রতি ১৭ অক্টোবর ২০০৮ সালে মীর মশাররফ হোসেনের নামে স্থানীয় সরকার বিভাগের অর্থায়নে ৫৪ লক্ষ টাকা ব্যয়ে জেলা পরিষদ কুষ্টিয়া কর্তৃক বাস্তবায়নের জন্য একটি লাইব্রেরী ও অডিটরিয়াম এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করবেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় মন্ত্রিপরিষদ সচিব জনাব আলী ইমাম মজুমদার।
লালন শাহের মাজার
আধ্যাত্মিক সাধক লালন শাহ’র কুমারখালীর ছেঁউড়িয়াতে আশ্রয় লাভ করেন এবং পরবর্তীকালে ছেঁউড়িয়াতে মৃত্যুর পর তাঁর সমাধি স্থলেই এক মিলন ক্ষেত্র (আখড়া) গড়ে ওঠে। ফকির লালন শাহের শিষ্য এবং দেশ বিদেশের অগনিত বাউলকুল এই আখড়াতেই বিশেষ তিথিতে সমবেত হয়ে উৎসবে মেতে উঠে। এই মরমী লোককবি নিরক্ষর হয়েও অসংখ্য লোক সংগীত রচনা করেছেন। বাউল দর্শন এখন কেবল দেশে নয়, বিদেশের ভাবুকদেরও কৌতুহলের উদ্রেক করেছে। ১৯৬৩ সালে সেখানে তার বর্তমান মাজারটি নির্মাণ করা হয় এবং তা উদ্বোধন করেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর মোনায়েম খান। ২০০৪ সালে সেখানেই আধুনিক মানের অডিটোরিয়ামসহ একাডেমি ভবন নির্মাণ করা হয়।
রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি
অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদা দ্বারকানাথ ঠাকুর শিলাইদহ জমিদারী ক্রয় করে ১৮১৩ সালে তিনি কুঠিবাড়িটি নির্মাণ করেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ, জ্যোতিবিন্দ্র নাথ, হেমেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ ঠাকুর বংশের প্রায় সকলেই পদ্মা গড়াই বিধৌত এখানে বসবাস করেন। মূলতঃ জমিদারী কাজকর্ম দেখাশুনার জন্য এই বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছিল। সে সময়ে ঠাকুর পরিবারে কুষ্টিয়ার শিলাইদহ; নাটোরের পতিসর ও পাবনার শাহজাদপুরে তিনটি জমিদারী ছিল। পারিবারিক আদেশে রবীন্দ্রনাথকে শিলাইদহে জমিদারী পরিচালনার জন্য এসেছিলেন। কুষ্টিয়া শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে এই কুঠিবাড়ী অবস্থিত। এখানে জেলা পরিষদের ডাক বাংলো আছে। পিয়ন এবং নৈশ প্রহরি আছে।
১৮৯৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেকে ব্যবসার সাথে জড়িয়ে ফেলেন। তিনি ও তার দুই ভাগ্নে সুরেন্দ্রনাথ ও বলেন্দ্রনাথ এর সহায়তায় শিলাইদহে ট্যাগোর এন্ড কোম্পানী গড়ে তোলেন যৌথ মুলধনী ব্যবসা। সে বছরই ব্যবসায়িক সুবিধার্থে টেগোর এন্ড কোম্পানী শিলাইদহ থেকে কুষ্টিয়ায় স্থানান্তরিত করেন। কোম্পানী দেখাশুনার জন্য কবি শহরের মিলপাড়ায় একটি দোতলা ভবন নির্মাণ করেন। এখানে বসে কবি অসংখ্য কবিতা লিখেন যা পরবর্তিকালে ‘‘ক্ষণিকা’’, কথা ও কাহিনীতে প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে এ ভবনটিও একটি দর্শনীয় স্থান।
এছাড়াও ঘুরে দেখতে পারেন কুষ্টিয়া শহর ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
যেভাবে যাবেনঃ
খুলনা বিভাগের অন্তর্গত কুষ্টিয়া জেলায় ঢাকা হতে সড়ক পথে ২ ভাবে আসা যায়।
১. ফেরী ঘাট হয়ে ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া – মানিকগঞ্জ মহাসড়ক পথে পাটুরিয়া ফেরী ঘাট থেকে ফেরী পারাপারের পরে দৌলতদিয়া রাজবাড়ী মহাসড়ক পথে রাজবাড়ী হয়ে কুষ্টিয়া সদর উপজেলা চৌড়হাস মোড়। চৌড়হাস মোড় থেকে কুষ্টিয়া শহরের দিকে যেতে দেড় কিঃমিঃ দূরে বাম দিকে কুষ্টিয়া সদর উপজেলা পরিষদ অবস্থিত।
২. বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া-টাঙ্গাইল মহাসড়ক পথে বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়ে সিরাজগঞ্জ-বনপাড়া মহাসড়ক পথে বনপাড়া হয়ে বনপাড়া পাবনা মহাসড়ক পথে পাবনার ঈশ্বরদী হয়ে লালন সেতু পার হয়ে ভেড়ামারা কুষ্টিয়া মহাসড়ক পথে কুষ্টিয়া মজমপুর বাসষ্ট্যান্ড। মজমপুর থেকে কুষ্টিয়া – ঝিনাইদহ মহাসড়কে ১ কিঃমিঃ দূরে ডান দিকে কুষ্টিয়া সদর উপজেলা পরিষদ।
এছাড়াও রেলপথেও আপনি কুষ্টিয়া চলে আসতে পারবেন। তবে ঢাকা থেকে গেলে সেই ক্ষেত্রে আপনাকে পোড়াদহ স্টেশনে নামতে হবে।
থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাঃ
আবাসিক হোটেল
১. হোটেল নূর ইন্টারন্যাশনাল২. পদ্মা হোটেল৩. হোটেল রিভারভিউ৪. হোটেল ড্রিমল্যান্ড৫. হোটেল বলাকা৬. হোটেল আজমিরী৭. শাহিন হোটেল৮. প্রিতম হোটেল
খাওয়ার হোটেল
১. মমতাজ হোটেল ২. জাহাঙ্গীর হোটেল ৩. বিসমিল্লাহ হোটেল ৪. শিল্পী হোটেল ৫. খাওয়া ও দাওয়া হোটেল ৬. আলামিন হোটেল উল্লেখযোগ্য
বন্ধুরা কুষ্টিয়া এসে কিন্তু এখানকার বিখ্যাত তিলের খাজা খেতে একদম ভুলবেন না। কোথাও ঘুরতে গেলে সেখানকার দর্শনীয় স্থানসমূহ দর্শনের পাশাপাশি সেখানকার ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলোও অবশ্যই খেয়ে দেখবেন।
[…] কুষ্টিয়া শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে কুমারখালি উপজেলার অর্ন্তগত শিলাইদহ ইউনিয়নের খোরেশদপুর কুঠিবাড়ি অবস্হিত । […]