স্যাটেলাইট টেলিভিশনের যুগে আমরা সকলেই ছোটবেলা থেকেই প্রতি ঈদে সকাল থেকে শুরু হওয়া শোলাকিয়া ঈদগাহ এর ঈদের নামাজের সাথে পরিচিত। প্রতিবছরই নানান টেলিভিশন সকাল থেকেই সরাসরি সম্প্রচার করে থাকে এই ময়দানের ঈদের জামাত। আজ পর্যটনলিপি আপনাদের সামনে উপমহাদেশের এই ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ নিয়ে কিছু তথ্য তুলে ধরবে।
শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান
ইতিহাস
কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক ঈদগাহের সৃষ্টির ইতিহাস সম্পর্কে অনেক জনশ্রুতি প্রচলিত রয়েছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, ১৮২৮ সালে এ মাঠের গোড়াপত্তন হয়। ওই বছরই স্থানীয় সাহেব বাড়ির উর্দ্ধতন পুরুষ সৈয়দ আহমদ (র:) তার তালুক সম্পত্তিতে তারই ইমামতিতে ঈদের প্রথম জামাত অনুষ্ঠিত হয়। পরে স্থানীয় হয়বতনগর দেওয়ান বাড়ির অন্যতম দেওয়ান মান্নান দাদ খানের বদান্যতায় এ মাঠের কলেবর বৃদ্ধি পায় এবং এর পরিধি বিস্তৃতি লাভ করে। দেওয়ান মান্নান দাদ খান ছিলেন বীর ঈসাখাঁর অধঃস্থন বংশধর। গোড়াপত্তনের পর বিভিন্নভাবে এবং বিভিন্ন কারণে এ মাঠের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বাড়তে থাকে এবং ক্রমান্বয়ে এ মাঠের প্রসার ও প্রসিদ্ধি ঘটে এবং দেশ ও দেশের বাইরে এর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
এ মাঠের নামকরণের বিষয়ে জনশ্রুতি হচ্ছে যে, বহুকাল আগে একবার এ মাঠে ঈদের জামাতে জামাতির সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১ লাখ ২৫ হাজার অর্থাৎ সোয়া লাখ। এই সোয়া লাখ থেকেই উচ্চারণ বিবর্তনে বর্তমান শোলাকিয়ার নামকরণ হয়েছে। অপর একটি ধারণা হচেছ, মোগল আমলে এখানে পরগনার রাজস্ব আদায়ের একটি অফিস ছিল। সেই অফিসের অধীন পরগণার রাজস্বের পরিমাণ ছিল সোয়া লাখ টাকা। জনশ্রুতি হচ্ছে, এটাও ‘‘শোলাকিয়া’’ নামকরণের উৎস হতে পারে। জানা গেছে, ঐতিহ্যবাহি এ মাঠে খ্যতিসম্পন্ন আলেমগণ ইমামতি করেছেন। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী প্রথম বড় জামাতের পর আরো যাঁরা ইমামতি করেছেন তাঁরা হলেন হযরত মাওলানা হাফেজ মুহম্মদ হযরত উল্লাহ, হযরত মাওলানা পেশওয়ারী, হযরত মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন, আলহাজ্ব মাওলানা হামিদুল হক, হযরত মাওলানা মাজহারম্নল হক, হযরত মাওলানা আবদুল গনি, হযরত মাওলানা আতহার আলী, হযরত মাওলানা আবদুল মান্নান, হযরত মাওলানা আবুল খায়ের মুহাম্মদ নূরুল্লাহ, মাওলানা আবুল খায়ের মুহাম্মদ সাইফুল্লা ও মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ।
জামাত
ঐতিহ্যবাহী ঈদগাহটি ১৮২৮ খ্রিঃ থেকে শুরু হয়ে বর্তমানে উপমহাদেশের সবচেয়ে বৃহত্ ঈদ জামাতের মাঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। প্রতি ঈদের জামাতে এ মাঠে তিন লাখের বেশি মানুষ নামাজ আদায় করেন। মাঠের ভেতরে ২৬৫ টি কাতার রয়েছে। কিন্তু স্থান সংকুলান না হওয়ায় মাঠ ছাড়িয়ে মুসল্লিগণ ঈদগাহ পার্শ্ববতী সড়ক, কুমুদীনি স্কুল মাঠ, নরসুন্দা নদী অপর পারে কিশোরগঞ্জ-করিমগঞ্জ সড়কের ওপর, বাড়ির উঠান, বাসার ছাদ এবং নিকটবর্তী এলাকায় নামাজে অংশ নেন। অল্প কিছু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা দুইতলা মিম্বারের ভবনটিতে নামাজ পড়েন, যেখানে প্রায় ৫০০ লোকের স্থান সংকুলান হয়।
এ মাঠের রেওয়াজ অনুযায়ী দফায় দফায় শটগানের গুলি ছোড়া হয় আকাশে । জামাত শুরুর ৫ মিনিট আগে ৩টি, ৩ মিনিট আগে ২টি এবং ১ মিনিট আগে ১টি গুলি ছোড়ার মাধ্যমে সবাইকে প্রস্তুত হওয়ার সংকেত দেওয়া হয়। নামাজ শেষে দেশ, জাতি ও মুসলিম উন্মাহর জন্য মঙ্গল কামনা করে মুনাজাত পরিচালিত হয়। লাখো লাখো আবাল বৃদ্বা বনিতার “আমিন আমিন” রবে মুখরিত হয়ে ওঠে ঈদগাহ ময়দান।
ঈদুল ফিতরের সময় ঈদগাহ ও এর আশপাশ এক ভিন্ন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মূল শহর থেকে ঈদগাহ মাঠ পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তায় মানুষের ঢল নামে। রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকে ভিক্ষুক ও বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসার লোকজন চাঁদা আদায়ের জন্য। সে সময় শহরের বিভিন্ন হোটেলে বাড়তি লোকের চাপ পড়ে এবং আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতেও লোকের ভিড় হয়। ঈদের জামাতকে কেন্দ্র করে ঈদগাহের পাশে মেলা বসে। এ মেলায় সুন্নতি লাঠি, তসবিহ, টুপি, রেহাল, সুরমা, জলচৌকি, পিঁড়িসহ বিভিন্ন কাঠের খেলনা ও কুটির শিল্পজাত দ্রব্যাদি ইত্যাদি পাওয়া যায়। নামাজ শেষে মুসলি্লরা এখান থেকে বিভিন্ন জিনিস ক্রয় করে বাড়ি ফেরেন।জানা যায়, তৎকালীন পাকিস্তান আমল ও ব্রিটিশ শাসনামলে এ মাঠে সুদূর আসাম ও কুচবিহার থেকে অসংখ্য ধর্মপ্রাণ মুসলি্ল ঈদের নামাজ পড়তে এখানে আগমন করতেন। পবিত্র ঈদের এই জামাতে এখনো জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের অসংখ্য মুসলি্লর সাথে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের হাজারো মুসলমান অংশ গ্রহন করেন। এখানে বৃহত্তর ময়মনসিংহের জেলাগুলো ছাড়াও সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, নরসিংদী, ঈশ্বরদীসহ কয়েকটি জেলা থেকে অনেক মুসল্লি নামাজ আদায় করতে আসেন। পাকিস্তান আমলে থেকেই এ মাঠে দুর দুরান্ত থেকে লোক আসার জন্য বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা রাখা হয়।
বিঃদ্র- করোনার বিধিনিষেধের কারণে এবারও গতবছরের ন্যায় খোলা ময়দানে নামাজ পড়ানো হবেনা। তাই এবছরও শোলাকিয়ার ময়দানে কোনো জামাত অনুষ্ঠিত হবেনা।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সকালে এবং সন্ধ্যায় এগারসিন্দুর আন্তঃনগর ট্রেনে কিশোরগঞ্জ পৌঁছে মাত্র ১৫/২০ টাকার রিকশা ভাড়ায় শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে পৌঁছা যায়। ট্রেনের ভাড়া প্রথম শ্রেণির চেয়ার ২০০/- টাকা, সুভন চেয়ার ১৫০/- টাকা এবং সুভন ১২০/- টাকা। এছাড়াও সায়েদাবাদ বাস স্ট্যান্ড থেকে নন-এসি অন্যন্যা সুপার, যাতায়াত, ঈশা খাঁ বাস সার্ভিস ভাড়া ২২০/- টাকা এবং এসি যাতায়াত বাস ভাড়া ৪০০/- এবং মহাখালী বাস স্ট্যান্ড থেকে নন-এসি অন্যন্যা, অন্যন্যা ক্লাসিক বাস ভাড়া ২২০/- টাকা। চট্টগ্রাম কিংবা অন্য কোনো বিভাগ থেকে যেতে চাইলেও আপনি কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন বাস কিংবা ট্রেন পেয়ে যাবেন। এছাড়াও বিভিন্ন জেলা থেকে মুসল্লিরা রিজার্ভ বাস নিয়ে ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ময়দানে জড়ো হয়। নামাজ শেষে তারা বাসে করেই চলে যান।
কন্টেন্ট রাইটারঃ শাহীন সুলতানা
[…] লিখেছেন যে, মোঘল আমলে নির্মিত এই ঈদগাহের মতো স্থাপত্যকলার নিদর্শন আর একটিও […]