সিরাজগঞ্জ জেলা , যা বাংলাদেশের ৬৪ জেলার ঢাকা এবং চট্টগ্রামের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই জেলাতেই রয়েছে বহুল পরিচিত বঙ্গবন্ধু যমুনা বহুমুখী সেতু (বাংলাদেশ এবং দক্ষিন এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম সেতু), পাশাপাশি আছে হার্ডপয়েন্ট, রাণীগ্রাম গ্রোয়েন, কাঁটাখাল, ইলিয়ট ব্রীজ – যেগুলো জেলাটির ঐতিহ্য বহন করে আসছে।
যমুনা পাড়ের ( সিরাজগঞ্জ জেলা ) গল্প
রাজধানী ঢাকা হতে ১৪২ কিলোমিটার দূরত্বে এই জেলার অবস্থান। এই জেলাকে একসময়ে কলকাতা এবং নারায়ণগঞ্জের পাশাপাশি পাট ব্যাবসা কেন্দ্র হিসেবে গণ্য করা হত। সেই ধারাকে বজায় রেখে বর্তমানে সিরাজগঞ্জ বাংলাদেশের প্রধান পাট বাণিজ্যকেন্দ্র। এখানকার তাঁতশিল্পও বেশ জনপ্রিয়।
ঘুরে আসি সিরাজগঞ্জ জেলা
উল্লাপাড়ার ঘাটিনা ব্রীজ সংলগ্ন এলাকায় প্রতিদিন বিকেলে আনন্দ ভ্রমণের জন্য লোকজন জড়ো হয়। এছাড়া বর্ষাকালে চলনবিল বেষ্টিত মোহনপুর, উধুনিয়া, বড়পাঙ্গাসী ও বাঙ্গালা ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ অঞ্চল নয়নাভিরাম শোভা ধারণ করে। সুফি সাধক শাহ কামাল (রহঃ) ধর্ম প্রচারের জন্য কামারখন্দে আসেন এবং তিনি ভদ্রঘাট ইউনিয়নের নান্দিনা কামালিয়া গ্রামে মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর কবরকে ঘিরে তৈরী হয়েছে মাজার শরীফ। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এ মাজার দর্শন করতে আসেন। মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী র জন্ম এই সিরাজগঞ্জ জেলাতেই।
সিরাজগঞ্জ শহরে ঘুরে দেখার মত অন্যতম একটি জায়গা হল শহর রক্ষা বাঁধ। সিরাজগঞ্জ শহর থেকে রিক্সা যোগে সহজেই চলে যেতে পারবেন এই মনোরম জায়গাটিতে। এই জায়গাটি হার্ডপয়েন্ট নামেও পরিচিত। সিরাজগঞ্জ শহরকে যমুনা নদীর ভাঙন থেকে রক্ষাকল্পে ১৯৯৬ হতে ২০০১ সালের মধ্যে ব্রিটিশ পরামর্শ ফার্ম হেলকো এন্ড পার্টনারের কারিগরী সহযোগিতায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই কোম্পানী কর্তৃক ৩৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে ২.৫ কি:মি: দীর্ঘ এ শক্ত বাঁধনির্মিত হয়। সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধ তথা হার্ডপয়েন্ট পানি সম্পদ মন্ত্রালয়ের অধীন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবোর্ড) এর তত্বাবধানে দক্ষ প্রকৌশলীগনের দিনরাত নিরলস পরিশ্রমের ফসল এই বাঁধ। এলাকায় প্রত্যহ প্রচুর সংখ্যক দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে।
যমুনা বহুমুখী সেতু
বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার দীর্ঘতম এবং বিশ্বের ১১তম দীর্ঘ সেতু দেখতে হলে কিন্তু আপনাকে এই জেলাতেই আসতে হবে। আর সেটা আমাদের সকলের পরিচিত বঙ্গবন্ধু সেতু। ১৯৯৮ সালের জুন মাসে এটি উদ্বোধন করা হয়। বাংলাদেশের ৩টি বড় নদীর মধ্যে সবচেয়ে বৃহত্তম এবং পানি নির্গমনের দিক থেকে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম নদী যমুনার উপর এটি নির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নামানুসারে সেতুটির নামকরণ করা হয়। বঙ্গবন্ধু সেতু বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে দুই অংশকে একত্রিত করেছে। এই সেতু নির্মাণের ফলে জনগণ বহুভাবে লাভবান হচ্ছে এবং এটি আন্ত আঞ্চলিক ব্যবসায় ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। সড়ক ও রেলপথে দ্রুত যাত্রী ও মালামাল পরিবহন ছাড়াও এই সেতু বিদ্যুৎ ও প্রাকৃতিক গ্যাস সঞ্চালন এবং টেলিযোগাযোগ সমন্বিত করার অপুর্ব সুযোগ করে দিয়েছে। টাঙ্গাইল থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত এই সেতু এশিয় মহাসড়ক ও আন্তঃএশিয় রেলপথের উপর অবস্থিত। এ দুটি সংযোগপথের কাজ শেষ হওয়ায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে উত্তর-পশ্চিম ইউরোপ পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন আর্ন্তজাতিক সড়ক ও রেলসংযোগ স্থাপিত হয়।সেতুটি নির্মাণে মোট খরচ হয় ৯৬২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আইডিএ, জাপানের ওইসিএফ প্রত্যেকে ২২ শতাংশ পরিমাণ তহবিল সরবরাহ করে এবং বাকি ৩৪ শতাংশ ব্যয় বহন করে বাংলাদেশ। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৪.৮ কিঃ মিঃ এবং প্রস্থ ১৮.৫ মিঃ।
বঙ্গবন্ধু যমুনা বহুমূখী সেতুর (বাংলাদেশের বৃহত্তম সড়ক ও রেলসেতু) পাশাপাশি সয়দাবাদ ইউনিয়নে বঙ্গবন্ধু যমুনা বহুমূখী সেতুসংলগ্ন একটি ‘ইকোপার্ক’ প্রতিষ্ঠা করা হলেও জনগণের চাহিদানুযায়ী এখনও গড়ে উঠেনি। পরিপূর্ণভাবে গড়ে উঠলে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের ব্যাপক সমাগম ঘটবে মর্মে আশা করা যায়। এছাড়া পৌর এলাকার হার্ডপয়েন্টে একটি পার্ক তৈরী করা হয়েছে। আবাসনের জন্য ইতোমধ্যেই শহর এলাকায় গড়ে উঠেছে দু’তিনটি উন্নতমানের আবাসিক হোটেল।
রবি ঠাকুরের কাচারিবাড়ি
সিরাজগঞ্জ জেলার আরেকটি বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান হল বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শাহজাদপুরের কাচারিবাড়ী। এটি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে অবস্থিত। এটি রবীন্দ্রনাথের পৈতৃক জমিদারি তত্ত্বাবধানের কাচারি ছিল। তারও পূর্বে অষ্টাদশ শতাব্দীতে এটি নীলকরদের নীলকুঠি ছিল। সে কারনে এখনও অনেকে একে কুঠিবাড়ী বলে। পরে রবীন্দ্রনাথের দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এটি নিলামে কিনে নেন। এখানে রয়েছে জমিদারির খাজনা আদায়ের কাচারির একটি ধ্বংসাবশেষ, একটি বেশ বড় দ্বিতল ভবন। বর্তমানে এখানে নির্মিত হয়েছে একটি আধুনিক অডিটোরিয়াম। দ্বিতল ভবনটি বর্তমানে রবীন্দ্র জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং আঙ্গিনার বিস্তৃত জায়গা জুড়ে তৈরী করা হয়েছে সুদৃশ্য একটি ফুলবাগান। রবীন্দ্রনাথ পিতার আদেশে ঊনত্রিশ বছর বয়সে ১৮৯০ সালে জমিদারি তত্ত্বাবধানের জন্য প্রথম শাহজদাপুর আসেন। রবীন্দ্রনাথ এখানকার প্রকৃতি ও মানুষের বিচিত্র জীবন প্রবাহের সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হন।
বড়াল নদীর চার্লস ইলিয়ট ব্রিজ
১৮৯২ সালে সেই সময়কার সিরাজগঞ্জের সাব ডিভিশনাল অফিসার মি. বিটসন বেল বড়াল নদীর উপর একটা ব্রীজ তৈরী করার কথা ভাবতে শুরু করেন। তৎকালীন সময়ে বড় বড় ব্যবসায়ীদের নিয়ে একটা কমিটি গড়লেন তিনি। ডিসট্রিক্ট বোর্ড থেকে অনুদান আদায় করে নিলেন ১৫০০ টাকার। আর ব্যবসায়ীরা এগিয়ে আসলেন যার যার সাধ্যমত। সিদ্ধান্ত হয়ে গেল খুব শিগগিরই একটা ব্রিজ তৈরীর কাজ শুরু হবে বড়াল নদীর উপর।তখনকার সময়ে বাংলা আর আসামের যে গভর্নর তাঁর নাম চার্লস ইলিয়ট । তিনিই এক শুভক্ষণে ১৮৮২ সালের ৬ আগস্ট ফাউন্ডেশন কাজের শুভ উদ্বোধন করলেন সেই ব্রিজের, বড়াল নদীর উপর। তার নামেই এই ব্রিজের নামকরণ করা হল ইলিয়ট ব্রীজ। ১৮৮২ সালে নির্মিত এই ইলিয়ট ব্রিজ আজও তার প্রথম দিনের সমৃদ্ধি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সিরাজগঞ্জ শহরে। ১৮০ ফুট লম্বা আর ১৬ ফুট চওড়া এই ইলিয়ট ব্রিজ এর প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হলো এতে কোন পিলার নেই! স্টুয়ার্ট হার্টল্যান্ড নামের ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত ইঞ্জিনিয়ারের তৈরী এই পিলার বিহীন একমাত্র আর্চ দিয়ে তৈরি ব্রিজটি নির্মাণে সেসময় পয়তাল্লিশ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছিল। আজও এই ইলিয়ট ব্রিজ সিরাজগঞ্জ শহরের একটি আকর্ষনীয় এবং দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য। হাজারো মানুষ আজও ছুটে যায় আসে এই ব্রীজটির সৌন্দর্য দেখার জন্য।
এছাড়াও আছে
এছাড়াও নবরত্ন মন্দির, হযরত মখদুম শাহদৌলা (রহঃ) এর মাজার ও মসজিদ, কবি রজনী কান্ত সেন এবং ছায়া ছবির কিংবদন্তী নায়িকা সূচিত্রা সেনের জন্ম স্থান সেন ভাঙ্গাবাড়ী গ্রাম, জয়সাগর দিঘি, আটঘরিয়া জমিদার বাড়ী এবং মকিমপুর জমিদার বাড়ীর মন্দির এর মত দর্শনীয় স্থানগুলো আপনারা ঘুরে দেখতে পারেন।
কিভাবে যাবেন সিরাজগঞ্জ
আপনারা বাস কিংবা ট্রেন যোগে সিরাজগঞ্জ যেতে পারেন। যদি বাসে চড়ে যেতে চান তাহলে চলে যান মহাখালী বাস স্ট্যান্ড। সেখানে অভি, এস আই, স্টারলিট ইত্যাদি পরিবহনের মাধ্যমে আপনি পৌঁছে যাবেন সিরাজগঞ্জ। ভাড়া কম বেশি ৩০০ টাকা। আর ট্রেনে যেতে চাইলে সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেসে করে যেতে পারেন। শনিবার ব্যতিত সপ্তাহের প্রতিটি দিনই কমলাপুর থেকে বিকাল ৫ টায় ছেড়ে যায়। ভাড়া শ্রেনী ভেদে ২০৫ টাকা এবং ২৪৫ টাকা হয়ে থাকে।
[…] এটি যমুনা নদী হিসেবে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনা নদী প্রবাহিত হয়ে গোয়ালন্দ ঘাটের নিকটে […]