Porjotonlipi

শিক্ষা সাহিত্যে সমৃদ্ধ ময়মনসিংহ জেলা

ময়মনসিংহ জেলা নিয়ে কথার শেষ নেই। উত্তরে গারো পাহাড় ও ভারতের মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণে গাজীপুর জেলা, পূর্বে নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলা এবং পশ্চিমে শেরপুর, জামালপুরটাঙ্গাইল জেলা বেষ্টিত ময়মনসিংহ জেলার ভৌগোলিক পরিবেশ বিচিত্র হওয়ায় বলা হয়-‘‘হাওর, জঙ্গল, মইষের শিং-এ নিয়ে ময়মনসিং”।

ময়মনসিংহ জেলা নিয়ে গল্প

শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের সূতিকাগার বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা ১৭৮৭ সালের ১মে জেলা হিসেবে জন্মের পর বর্তমান ময়মনসিংহের আদল পায় ১৯৮৪ সালে। ৪,৭৮৭ বর্গমাইলের রত্নগর্ভা এ জেলার প্রাণবন্ত মানুষের পরিচয় পাওয়া যায় এর নামের মাঝেই- My-men-sing অর্থাৎ আমার লোকেরা গান গায়। মহুয়া-মলুয়ার দেশ ময়মনসিংহের পূর্ব নাম ছিল নাসিরাবাদ। মোঘল আমলে মোমেনশাহ নামে একজন সাধকের নামে অঞ্চলটির নাম হয় মোমেনশাহী- কালের বিবর্তনে যা ময়মনসিংহ নামে পরিচিতি লাভ করে। ময়মনসিংহ শহরের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে ব্রহ্মপুত্র নদ। এ নদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন বহু ছবি এঁকেছিলেন। এখানকার বহু স্থাপনায় প্রাচীন নির্মাণ শৈলীর ছোঁয়া রয়েছে। আছে কালের সাক্ষী স্বরূপ ভগ্ন জমিদার বাড়ী।আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিও জড়িয়ে আছে এ জেলার ত্রিশাল উপজেলার সাথে। সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ আর বৈচিত্র্যপূর্ণ জনগোষ্ঠির এক জনপদ এ ময়মনসিংহ জেলা।

Mymensing2

ময়মনসিংহের দর্শনীয় স্থান

এই জেলাতে দেখার মত অনেক কিছুই রয়েছে। এদের ভিতর শশী লজ, শহীদ আব্দুল জব্বার জাদুঘর, মহারাজ সূর্যকান্তের বাড়ি, গারো পাহাড়, নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র, মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ী এবং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালা অন্যতম।

মহারাজ সূর্যকান্তের বাড়ি

টাউন হল মোড় থেকে বাস যোগে চলে যেতে পারেন মুক্তাগাছায়। সেখানেই এই বাড়ী অবস্থিত। মুক্তাগাছা শহরে শিবরামের বসতবাড়ির অংশ ছিল বর্তমান কলেজবাড়ি। শিবরামের পুত্র ছিল রঘুনন্দন। তিনি অপুত্রক হওয়ায় গৌরিকামত্মকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করেন। গৌরিকান্তের পুত্র ছিল কাশিকান্ত, তবে কাশিকান্ত অপুত্রক হওয়ায় তার স্ত্রী লক্ষী দেবী ফরিদপুরের বাজিতপুর গ্রাম থেকে সূর্যকান্তকে দত্তক পুত্র হিসাবে আনেন। এই সূর্যকান্তের নামেই বাড়িটি পরিচিতি লাভ করে। রাজা সূর্যকান্ত অপুত্রক হওয়ায় তিনি রাজা জগৎকিশোরের পুত্র শশীকান্তকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করেন। শশীকান্ত বাংলা ১১২০ সালে বাংলার গভর্নর লর্ড রোনাল্ড কর্তৃক মহারাজা উপাধি পেয়েছিলেন। তিনি ১৯১৩ সালে বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। মহারাজা সূর্যকান্ত’র বাড়ির ভিতরের অংশ ভেঙ্গে ফেলে নতুনভাবে শহীদস্মৃতি সরকারী কলেজের জন্য দুটি একাডেমিক দ্বিতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।

তবে বাড়িটির সম্মুখভাবে ভবনটির নির্মাণশৈলী অক্ষুন্ন রেখে দ্বিতল ভবনে রূপান্তর করা হয়েছে যার নিচতলা প্রশাসনিক ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই বাড়ীর সম্মুখভাগের কারুকর্মখচিত দৃষ্টিনন্দন নির্মাণশশৈলী পর্যটকদের আকর্ষনীয় বস্তু ।

 

Mymensing3

মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ি

হরেরাম ও তার বংশধরদের জন্য নির্মাণ হয়েছিল এই বাড়ি। হরেরামের দুই পুত্র, রামকান্ত ও কৃষ্ণকান্ত। এরা দুজনেই অপুত্রক অবস্থায় মারা যান। জমিদার আচার্য চৌধুরী বংশ মুক্তাগাছা শহরের গোড়াপত্তন করেন । আচার্য চৌধুরী বংশ শহরের গোড়াপত্তন করে এখানেই বসতি স্থাপন করেন। আচার্য চৌধুরী বংশের প্রথম পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরী ছিলেন বগুড়ার বাসিন্দা। তিনি মুর্শিদাবাদের দরবারে রাজস্ব বিভাগে কর্মরত ছিলেন। তিনি ছিলেন নবাবের খুবই আস্থাভাজন। নবাবের দরবারে রাজস্ব বিভাগে কর্মরত থাকা অবস্থায় ১১৩২ সালে তিনি সেই সময়ের আলাপসিং পরগণার বন্দোবসত্ম নিয়েছিলেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বর্তমানে মুক্তাগাছা শহরসহ মুক্তাগাছা উপজেলার বেশিরভাগই ছিল আলাপসিং পরগণার অন্তর্ভূক্ত। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর নানা কারণে শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরীর ৪ ছেলে বগুড়া থেকে আলাপসিং এসে বসবাসের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরীর এই ৪ ছেলে হচ্ছে রামরাম, হররাম, বিষ্ণুরাম ও শিবরাম। বসতি স্থাপনের আগে তারা এ পরগণার বিভিন্ন স্থান ঘুরে ফিরে দেখেন এবং বর্তমান মুক্তাগাছা এলাকায় বসতি স্থাপনের জন্য মনস্থির করেন। সে সময়ে আলাপসিং পরগণায় খুব একটা জনবসতি ছিলনা। চারদিকে ছিলো অরণ্য আর জলাভূমি। শ্রীকৃষ্ণ আচার্য্যের ৪ছেলে ব্রহ্মপূত্র নদের শাখা নদী আয়মানের তীরবর্তী স্থানে নৌকা ভিড়িয়ে ছিলেন। জমিদারদের পরিত্যক্স সেই বাড়ীটি সহজেই পর্যটকদের মন কাড়ে ।

রাজা মহারাজাদের বাসস্থান ময়মনসিংহ

ময়মনসিংহ শহরে জুবিলী উৎসব পালনের লক্ষ্যে ১৮৭৯ সালে ৪৫ হাজার টাকা ব্যয়ে মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য এক সুদৃশ্য ভবন নির্মাণ করেন যার নাম লোকমুখে লোহার কুঠির নামে পরিচিত। হ্যাঁ বন্ধুরা আমরা আলেকজান্ডার ক্যাসেলের কথাই বলছি। মনোরম নৈসর্গিক এই ভবনটিতে তৎকালীন ভারত সম্রাট এডওয়ার্ডের পত্নী সম্রাজ্ঞী আলেকজান্ডার চিত্র স্থাপন করা হয়। যার কারণে এই ভবনের নাম করা হয় আলেকজান্ডার ক্যাসেল। নিপুন শিল্পীর হাতে গড়া সেই প্রাসাদ আজ আর নেই। শুধুমাত্র কালের সাক্ষী হিসেবে তাদের ব্যবহৃত লাইব্রেরী কাম বৈঠকখানাটি টিকে আছে, সামনে মুরাল মূর্তিটি নিয়ে।

জরুল ইসলামের স্মৃতি বিজড়িত ত্রিশাল উপজেলা

কাজির শিমলা দারোগা বাড়ী যেখানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এদেশে প্রথম পদার্পণ হয়েছিল। কিশোর নজরুলের সুকুমার চেহারা, নম্র স্বভাব ও প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে দারোগা জনাব রফিজুল্লাহ নজরুলকে ১৯১৪ সালের প্রথম দিকে ত্রিশালের কাজির শিমলায় নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন এবং দরিরামপুর হাই স্কুলে ৭ম শ্রেনীতে ভর্তি করিয়ে দেন। প্রথমে এই দারোগাবাড়িতে অবস্থান করেই কবি লেখাপড়া করেন। সেই স্মৃতির উদ্দেশ্যেই এই স্মৃতিকেন্দ্র নির্মিত।

জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালা

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের সংগ্রহশালা কিন্তু এই জেলাতেই অবস্থিত। শিল্পীর নিজ শহরে ১৯৭৫ সালের ৭ জুলাই প্রতিষ্ঠিত হয় এই সংগ্রহশালা। এটি ৭০ টি শিল্পকর্ম নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও ১৯৮২ সাল নাগাদ ১৭ টি বিখ্যাত শিল্পকর্ম চুরি হয়ে যায়। প্রশাসনের সহায়তায় ১৯৯৪ সালে ১০ টি উদ্ধার করা সম্ভব হয়। এই সংগ্রহশালায় মোট ৫৩ টি চিত্রকর্ম রয়েছে।

মুক্তাগাছার মন্ডা

ময়মনসিংহ এসে মুক্তাগাছার মন্ডা কিন্তু অবশ্যই খেয়ে যাবেন। ১৮২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘গোপাল পালের মন্ডার দোকান’ এর মন্ডা না খেলেন তো হেরে গেলেন।

কিভাবে যাবেন ময়মনসিংহ জেলা ঘুরতে

ঢাকা থেকে ময়মনসিংহের দূরত্ব ত্রিশাল হয়ে ১১৯ কিলোমিটার, আর যদি টাঙ্গাইল হয়ে আসেন তাহলে ১৯৩ কিলোমিটার। মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে প্রায় সারা দিন ময়মনসিংহগামী বাস পাবেন। আপনি চাইলে ঢাকা থেকে ট্রেইনে চড়েও আসতে পারেন এই জেলায়। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ যেতে সময় লাগবে কম বেশি ৩ ঘন্টা। ময়মনসিংহে থাকার জন্য সরকারি / বেসরকারি বেশ কিছু হোটেল রয়েছে, সুতরাং থাকা নিয়ে তেমন কোন ঝামেলা পোহাতে হবে না বললেই চলে।

 

 

Porjotonlipi Desk

Add comment