Porjotonlipi

ঐতিহাসিক মেহেরপুর জেলা

মেহেরপুর জেলা ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি উভয় শাসনামলের নিদর্শন ধারণ করে আসছে বছরের পর বছর। কাকতালীয় ভাবে পলাশী আম্রকাননে বাংলার যে স্বাধীন সূর্য অস্তমিত হয়েছিল ১৭৫৭ সালে, ২১৪ বছর পর তার অদূরবর্তী মেহেরপুর আম্রকাননে ১৯৭১ সালে পুনরায় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করেছিল।

মেহেরপুর জেলা ও তার ইতিহাস

মেহেরপুর শুনলেই তাই ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া নীলকুঠি ও পাকিস্তানিদের চোখ এড়িয়ে মুজিবনগরের শপথ গ্রহনের স্বর্নালী ইতিহাসের কথা মনে করিয়ে দেয়। ইতিহাসের পাতা থেকে মুজিবনগর ও নীলকুঠি হতে পারে মেহেরপুর জেলা ভ্রমণের অন্যতম আকর্ষণ।

বৈদ্যনাথতলা থেকে মুজিবনগর

মেহেরপুর জেলার তিনটি উপজেলার মধ্যে অন্যতম মুজিবনগর উপজেলা। স্বাধীন বাংলার সূচনালগ্নের এক অবিস্মরণীয় ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল মুজিবনগর।

বৈদ্যনাথতলার এক অখ্যাত আমবাগানে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে শপথ নেয় বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার। শত্রু দ্বারা আক্রমণের সম্ভাবনা কম ও ভারত সীমান্ত সংলগ্ন হওয়ায় এবং স্থল, জল ও আকাশ পথ সব ভাবেই দূর্গম মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা অস্থায়ী মুজিব সরকার গঠনের জন্য বাছাই করা হয়। দূর্গম সেই বৈদ্যনাথতলায় যাওয়ার রাস্তাঘাট ছিল নষ্ট, ঘন আমবাগানের ছায়ায় মঞ্চ স্থাপন করা হয়েছিল, এই অভূতপূর্ব পরিকল্পনায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর স্থল ও আকাশপথে আক্রমণের সম্ভাবনা কম ছিল। ১০ এপ্রিলে যে সরকার গঠিত হয়েছিল ১৭ এপ্রিলের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের সাক্ষী হয়েছিল সেদিন ওই ঘন আমবাগানের পাতার আচ্ছাদনের বৈদ্যনাথতলা। নবগঠিত সরকারের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের দেয়া ভাষন অনুপ্রেরণা দিয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার যোদ্ধাদের। এভাবেই বাংলাদেশের মেহেরপুরের দূর্গম বৈদ্যনাথতলা হয়ে উঠেছিল মুজিবনগর।

স্মৃতিবহুল মুজিবনগর

মুজিবনগর মেহেরপুর জেলা সদর থেকে ১৮ কি.মি. দূরে। মুজিবনগর বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ণ নিদর্শন। তৎকালীন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করে ১৯৭৪ সালে মুজিবনগর স্মৃতি জাদুঘরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়, ১৯৮৭ সালে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ এবং ১৯৯৬ সালে মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্স এর কাজ শুরু করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে সঠিক আর স্বচ্ছ জ্ঞান আর শিক্ষাই পারে বর্তমান প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে। মুজিবনগর তাই স্কুল পর্যায় থেকে শিক্ষার্থীদের ভ্রমণ ও পূর্ণ ধারণা দেয়ার একটি অন্যতম স্থান হিসেবে গণ্য করা যায়। এছাড়াও দেশি বিদেশি পর্যটকেরা মুজিবনগর ও আম্রকাননে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে আসে।

৮০ একর জায়গায় দাঁড়ানো মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্স, ৪০ একর জায়গায় আম্রকানন যাতে আমগাছ আছে ১৩’শ, যার ছায়ায় বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন হয়েছিল মনে পরিয়ে দেয় জাতীয় সংগীতের চরণ, “ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে”। এছাড়াও ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু কতৃক উত্থাপিত বাঙালির ছয়দফা আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে ৬ স্তর বিশিষ্ট ২ টি গোলাপবাগান আছে , যাতে ২২’শ গোলাপগাছ আছে।

মুজিবনগর কমপ্লেক্সের মূল আকর্ষণ বাংলাদেশের মানচিত্র। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও গঠনের আদলে নির্মিত এই স্থাপনায় বাংলাদেশের নদী, দক্ষিনাঞ্চলের ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন, বঙ্গোপসাগর, পার্বত্য এলাকাগুলোয় নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১১ টি সেক্টরের ভাগ দেখানো হয়েছে, দেখানো হয়েছে পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন ধ্বংসযজ্ঞের প্রতীকী রূপ, বাংলাদেশের বিভিন্ন বয়সের শরনার্থীদের ভারত সীমান্ত অতিক্রম করার চিত্র। একনাগাড়ে কিছু সময় মানচিত্রটি পর্যবেক্ষণ করলে মনে হবে হয়ত এখানে সময়টা সেই ১৯৭১ সালের বাংলাদেশে আটকে গেছে।

মানচিত্রটি ঘিরে গোলাকার কমপ্লেক্সের ভিতর ও বাহিরে চোখে পরার মত ভাষ্কর্য আছে প্রায় ৪’শ এর মত, যা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিপীড়ন ও নির্মম হত্যাযজ্ঞ, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষন, বাঙ্গালীর প্রতিরোধ, মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ এবং পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণসহ অন্যান্য বিশেষ বিশেষ ঘটনার চিত্র তুলে ধরেছে।

মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ অন্যতম স্থাপত্য নিদর্শন যা একই সাথে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত সকল স্মৃতির রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্রদর্শন করে আসছে বহু বছর ধরে।

স্মৃতিসৌধে দাড়ালে আপনি দেখতে পাবেন মূল বেদী একটি লাল সূর্য যা নতুন দেশ নতুন সূর্যের প্রতীক। সূর্য ঘিরে রয়েছে ২৩ টি পিলার, পাকিস্তানের নিপীড়ন থেকে ২৩ বছর পর বাঙালীর মুক্তির নতুন সূর্যের কিরণের প্রতীক। সূর্য ঘিরে রয়েছে নূড়ি পাথর যা ১লক্ষ বুদ্ধিজীবীর খুলির প্রতীক, এছাড়াও বেদীতে প্রতীকী ভাবে তৎকালীন ১৯ টি জেলার ভাগ দেখিয়ে ৩০লক্ষ শহীদদের সম্মান জানিয়ে প্রতীকী পাথর বিছানো হয়েছে। সম্পূর্ণ স্মৃতিসৌধে ভাষা আন্দোলনের রাস্তা, রক্তের সাগর এবং সারে ৭কোটি জনগনের প্রতীকী রূপ দেখানো দেখানো হয়েছে। এছাড়াও যে ১১ টি সিড়ি পার করে আপনি বেদীতে উঠবেন তা বাংলাদেশের ১১টি যুদ্ধ সেক্টরের প্রতীক।

মুজিবনগর রাতে থাকতে চাইলে স্মৃতি কমপ্লেক্সের ভিতর পর্যটন কর্পোরেশনের আবাসিক হোটেলে থাকার সুব্যবস্থা আছে।

কালের সাক্ষী নীলকুঠি

নীলকুঠি শুনলেই আজও আমরা ফিরে যাই ১৭৭৭ সালে যখন ভারতবর্ষে প্রথম নীল চাষ শুরু করে ইংরেজ বণিকরা আর অনিচ্ছা সত্বেও নীল চাষে বাধ্য হওয়া অসহায় কৃষকদের মুখ। এই নীল চাষ শুরু হলে ইংরেজরা বিভিন্ন স্থানে কুঠি স্থাপন করে নীল চাষ পরিচালনার জন্য। ব্রিটিশ শাশনামলের এই কুঠিগুলো নীলকুঠি নামে পরিচিত আর আজও কালের বিবর্তনে বিভিন্ন স্থানে এসব নীলকুঠি দাঁড়িয়ে আছে নির্মমতার নিদর্শন হয়ে।

আমঝুপি নীলকুঠি 

মেহেরপুর জেলা সদর থেকে ৭ কি.মি. দূরে ঘুরে আসতে পারেন আমঝুপি নীলকুঠি যা ইংরেজদের শাশনামল এর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। ইতিহাসবিদদের মতে ১৮০০ সালের দিকে প্রায় ৭৭একর জায়গা জুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আমঝুপি নীলকুঠি, যার প্রবেশপথ দুইটি, মাঝে মূল ভবন ঘিরে রয়েছে ফুলের বাগান। কুঠির পাশেই রয়েছে কাজলা নদী। ১৯৭২ সালে প্রথম এই আমঝুপি নীলকুঠি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ সরকার।

ভাটপাড়া নীলকুঠি 

মেহেরপুর জেলা সদর থেকে ১৭কি.মি. দূরে ভাটপাড়া নীলকুঠি অবস্থিত যা ২০১৭ সাল থেকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ শুরু করা হয়। ২৭ একর জমিতে অবস্থিত কুঠিবাড়িটির মূল ভবনটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। এছাড়াও ভগ্নদশায় আছে নীলকুঠির জেলখানা, মৃত্যুকূপ ও ঘোড়ারঘর। তবে পর্যটন আকর্ষণ হিসেবে গড়ে তুলতে কৃত্রিম লেক, ঝর্ণা, ফুলের বাগান, পার্ক স্থাপন করা হয়েছে।

১৭৫৭ থেকে বর্তমান 

১৭৫৭ সালে স্বাধীন বাংলার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল পলাশীর প্রান্তরে, ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা ফিরে পেয়েছি আমাদের বাংলার স্বাধীনতা।

চোখ বন্ধ করে একবার “বাংলাদেশ” উচ্চারণ করে ভেবে দেখুন এই বাংলা ভাষা আপনার আমার, আমাদের সবার পরিচয়, আমাদের ঠিকানা “বাংলাদেশ”, মাথা উঁচু করে বলতে পারি, “বাংলাদেশী”।

পর্যায়ক্রমে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাশনের পর যে দেশপ্রেমের তীব্রতায় ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম, সেই স্বাধীনতা প্রজন্মের পর প্রজন্মে স্থানান্তরিত করার দায়িত্বও আমাদের। আর এই দায়িত্বের সঠিক পালন হওয়া সম্ভব দেশপ্রেমের উপলব্ধি করানোর মাধ্যমে। শুধুমাত্র পাঠ্যবইয়ে সীমাবদ্ধ না রেখে শিক্ষার্থীদের ঐতিহাসিক স্থানে ভ্রমণ করা ও স্থান সম্পর্কে জানার আগ্রহ গড়ে তুলুন। আজ আমরা যে স্বাধীন দেশে দাঁড়িয়ে আছি তা অগণিত দেশিপ্রেমিকের আত্মত্যাগের বিনিময়ে প্রাপ্ত। এই দেশ আপনাকে কি দিয়েছে না ভেবে, দেশকে নিজে কিছু দেয়ার চেষ্টা করুন। নিজের দেশকে ভালবাসুন।

কন্টেন্ট রাইটার- সুমাইয়া নাসরিন তামান্না

 

Porjotonlipi

Add comment