মালকা বানুর দেশে রে, বিয়ের বাদ্য আলা বাজে রে / মালকার বিয়া হইল মনু মিয়ার সাথে রে… বাংলাদেশের বিখ্যাত লোকগান। মালকা বানু সম্পর্কে কখনো শুনেছেন কিছু? বাংলাদেশের লোকগানের সুনাম আছে সর্বত্র। আজকে আমরা জানব গানে উল্লেখিত এই দুইজন ব্যাক্তি এবং তাঁদের লোকগানের ইতিহাস সম্পর্কে।
মালকা বানুর দেশে
লোকগানের দুই চরিত্র – মনু মিয়া এবং মালকা বানু ছিলেন দম্পতি। চট্টগ্রামের ইতিহাসগ্রন্থ দেয়াঙ পরগণার ইতিহাস এর ভাষ্যমতে, তৎকালীন বাংলার মুঘল শাসনের সম্রাট ছিলেন শাহজাহান, যার দ্বিতীয় পুত্র শাহ্ সুজা (শাহাজাদা সুজা) ’র সেনাপতি ছিলেন শেরমস্ত খাঁ, এবং তার পুত্রই ছিলেন জবরদস্ত খাঁ ওরফে মনু মিয়া। পূর্বে কাট্টলী ’র জমিদার দেওয়ান বদিউজ্জামান এর বোন খোরসা বানু’র সাথে মনু মিয়ার বিবাহ হয়। দুর্ভাগ্যবশত খোরসা বানু কোন সন্তান ধারণ না করায় চট্টগ্রামের বাশখালী উপজেলার সরল গ্রামের এক সওদাগরের কন্যা মালকা বানুকে বিবাহ করেন মনু মিয়া। লোকমুখে শোনা যায় এই বিবাহ নিয়ে বেশ কথাবার্তা, যেটি পরবর্তীতে লোকগানে রুপ নেয়।
সেই ইতিহাস গ্রন্থে বিস্তারিত ভাবে বলা হয়েছে, মনু মিয়া একদিন সরল গ্রাম দিয়ে লোকসমেত যাওয়ার কালে মালকা বানুকে দেখেন, এবং প্রথম দেখাতেই ভাল লেগে যায়। সেই ভাল লাগা থেকে নাওয়া-খাওয়া ভুলে গিয়ে সারাদিন মালকা বানু’র চিন্তায় ডুবে থাকতেন মনু মিয়া। এই প্রেমের কানাঘুষা ছড়িয়ে পরে সারা গ্রামে। পরবর্তীতে গ্রামের মক্তবের কাজি, যার থেকে মালকা বানু কোরআন শিক্ষা নিতেন, তার মাধ্যমে মালকা বানুকে নিকাহ করার প্রস্তাব প্রেরণ করেন মনু মিয়া। মালকা বানু’র পিতা এই প্রস্তাবে সায় দিলেও মালকা বানু দিয়ে বসেন এক শর্ত – তিনি জলপথ ভয় পান, সুতরাং তিনি যাবেন সড়কপথে। তখন সড়কপথ না থাকায় মনু মিয়া তড়িঘড়ি করে হাজার শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে শঙ্খ নদে বাঁধ দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করান। নির্মাণ কাজ শেষে শুরু হয় বিয়ের প্রস্তুতি, মালকা চলে আসলেন মনু মিয়ার ঘরে। এত জল্পনা কল্পনার পরেও মনু মিয়ার ঔরসে মালকা বানু’র কোনো সন্তান হয়নি।
মনু মিয়ার ‘জবরদস্ত’ প্রতিপত্তি এবং তার বর্তমান অবস্থা
ইতিহাসে আছে, মনু মিয়ার পিতা শেরমস্ত খাঁ ছিলেন প্রচুর প্রতিপত্তির অধিকারী, যার ছিল হাজারখানেক সৈনিক, শক্তিশালী মোগলাই কামান, যুদ্ধে ব্যাবহৃত ব্যাপক হাতি-ঘোড়া, বিপুল পরিমাণ যুদ্ধের সরঞ্জাম এবং আগ্নেয়াস্ত্র। এই কারণে তাঁদের বাড়ির বাম এবং ডান পাশের এলাকার নামকরণ হয় যথাক্রমে লস্কর ভিটে এবং উজির ভিটে, এবং হাজারখানেক সৈন্য কেন্দ্র করে বটতলী গ্রামের পূর্বপাশে হাজারী দুর্গ বা হাজারীহাটের নামকরণ হয়। ১৯৮০ সালে মনু মিয়ার বাড়ির পশ্চিমপাশ থেকে প্রায় সাড়ে ২৭ মণ ওজনের একটি কামান উদ্ধার করা হয়, যেটি উদ্ধারের পর শাহ্ সুজা’র সেনাপতি শেরমস্ত খাঁ‘র তৎকালীন অবস্থা নিশ্চিত করে দেয়। কামানটি বর্তমানে চট্টগ্রাম নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে রয়েছে।
লোকগানের মনু মিয়া’র বাড়ি চট্টগ্রামের আনোয়ারাতে, যেখানে মনু মিয়া’র আদেশে নির্মিত স্থাপনা এখনও সাক্ষ্য দিচ্ছে বর্ণিল ইতিহাস। সেই গ্রামে রয়েছে মনু মিয়া’র আদেশে নির্মিত একটি মসজিদ, যেটিকে মোঘল আমলে মূল অবকাঠামো ঠিক রেখে সামনের দিকে কিছুটা সম্প্রসারণ করা হয়। ২০ ও ৪০ ফুট উচ্চতার মসজিদের ভিতরের এবং বাইরের দেয়ালে রয়েছে মনোমুগ্ধকর কারুকাজ, রয়েছে সৌন্দর্যমণ্ডিত গম্বুজ। মসজিদে প্রবেশপথে একটি ফলকে খণ্ডাইত আছে, “মোগল আমলের শেষের দিকে জমিদার জবরদস্ত খাঁ (মনু মিয়া) এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। তিনি তাঁর প্রথমা স্ত্রী খোরসা বানুর নামে এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। তাঁর আরেক স্ত্রী ছিলেন বাঁশখালীর সরল গ্রামের বিখ্যাত মালকা বানু। নির্মাণের পর থেকে এই মসজিদটি আর সংস্কার করা হয়নি। চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ, ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ও এর সৌন্দর্য বাড়াতে ১৪১৭ এবং খ্রিষ্টাব্দ ২০১০ সালে মসজিদটিতে টালি সংযোজন ও সংস্কার করে।’’
মনু মিয়া মারা যাওয়ার পরে কাজির পাহাড় এলাকায় তাঁকে দাফন করা হয়। বৈবাহিক জীবনে মনু মিয়া সন্তানপ্রাপ্ত না হলেও তার মৃত্যুর পরে তার আদেশে নির্মিত মসজিদ, কবরস্থান, সুবিশাল দিঘী সহ বিভিন্ন স্থায়ী সম্পত্তি এখনও জানান দিয়ে যাচ্ছে কিরকম ছিল মনু মিয়া এবং তার পিতার আমলের মোঘল ইতিহাস।
Add comment