Porjotonlipi

ভারতবর্ষ ভ্রমণে, ইতিহাসের সন্ধানে (পর্ব ৩)

ভারতের ছোট থেকে ছোট শহরে আছে ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের স্পষ্ট ছাপ। সেই ইতিহাসসমৃদ্ধ বিভিন্ন স্থানে বেড়াতে গেলে ছোটবেলা থেকে বইতে পড়া কঠিন ইতিহাস গুলকে অনেক সহজেই বুঝতে পারা যায়। এমনকি জানা যায় যেগুলো বইতে পড়িনি, সেইসব বিচিত্র ইতিহাস সম্পর্কেও। ঠিক এমনই এক জায়গা মুঘল সম্রাট আকবরের সাময়িক রাজধানী ফতেহপুর সিকরি। ট্যুরগাইড সাথে করে নিয়ে ঘোরার দরুন জানা হয়েছে এর বিশদ ইতিহাস সম্পর্কে এবং জায়গাটি মনের মধ্যে গেঁথে আছে সবচেয়ে গভীরতম স্মৃতি হিসেবে। বছর দুয়েক আগে ঘুরে আসার পরও চোখে দেখে আসার অনুভব গুলো এখনও অনেকখানি সতেজ।

ইতিহাসে মোড়ানো ফতেহপুর সিকরি

তাজের আগ্রাকে বিদায় জানিয়ে আমাদের যাত্রা আরেক শহর জয়পুরের উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে, আগ্রা হতে ৩১ কিলোমিটার পূর্বে এই সাময়িক মুঘল রাজধানী ফতেহপুর সিকরি এর অবস্থান। আমার ভাষ্যমতে, আমার দেখা ভারতের ঐতিহাসিক স্থানের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা এটি। এর কোণায় কোণায় রয়েছে চমকপ্রদ গল্প। সেগুলো বলার আগে একটু জেনে আসি ইতিহাস কি বলে।

সারাংশিত ইতিহাস

ফতেহপুর সিকরি বা বিজয়ের শহর – যার নির্মাণ প্রায় ৪৫২ বছর পিছনে অর্থাৎ ১৫৮৫ করা হয়েছিল। এটি ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় স্থানের তালিকাভুক্ত হয় ১৯৮৬ সালে। ১৫৭১ সাল থেকে ১৫৮৫ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরের পরিশ্রম শেষে সুবিশাল, কয়েকটি বাসস্থান ভবন এবং প্রশাসনিক ভবনের সমন্বিত এক রাজ্যে রুপান্তরিত হয় এই সিকরি। ষোড়শ শতকে মুঘল আমলে এই ফতেহপুর ১০ বছরের মত রাজধানী ছিল। নির্মাণের ৭ বছর পরে পানি স্বল্পতার কারণে সিকরিকে পরিত্যাগ করা হয়।

কি রকম দেখতে এই ফতেহপুর সিকরি

ফতেহপুর মুঘল আমলের সবচেয়ে পরিকল্পিত শহর। সিকরির ভবনগুলোর আশি শতাংশই ইটের ব্যাবহার, বাকি বিশ শতাংশে আছে মার্বেলের ব্যাবহার। সিকরি রাজ্যে আছে কয়েকটি ভবন যেগুলো হল – বিচারভবন, বাসস্থান, বিনোদনখানা, মসজিদ, মন্দির, এবং রান্নাঘর। ভবনগুলো যেখান থেকে শুরু হয়েছে, তার বাইরে রয়েছে এক সুদীর্ঘ সবুজ প্রাঙ্গন। এই প্রাঙ্গনের এক জায়গায় দাফন করা হয়েছে আকবরের পোষা হাতি কে, যেটিকে অনেক সময় শাস্তি দেয়ার জন্য ব্যবহার করা হত।  সিকরির বাহিরে রয়েছে জামে মসজিদে প্রবেশ করার জন্য রয়েছে ৪০ফিট লম্বা এবং ৫০ফিট প্রশস্ত এক দরজা যার নাম বুলন্দ দরওয়াজা বা বিজয়ের ফটক, যেটি সম্রাট আকবরের গুজরাট বিজয়ের মুহূর্তগুলকে স্মরণ করিয়ে দেয়। দরজাটি ১৬০২ সালে বানানো হয়েছিল। সিকরি থেকে খানিকটা দূরে আছে সুফী দরবেশ সেলিম চিশতীর শ্বেত মাজার যার ভবিষ্যৎ বাণীতে আকবরের দ্বিতীয় স্ত্রী যোধাবাই এর গর্ভে সন্তান এসেছিল।

ফতেহপুর সিকরি এর মহল গপ্পো

শুরুতে বলি প্রশাসনিক ভবনের কেচ্ছা। ভবনটি ছিল সম্পূর্ণ লাল ইটের তৈরি, সর্বত্র ছিল হাতে করা নকশী কাজ, যা দেখলে মনের মধ্যে এক প্রশ্ন জাগে, হাতে করে কিভাবে এত সুন্দর নিখুঁত কাজ করা যায় ? ১৫ বছরের দীর্ঘ  নির্মাণ সময়য়ের জন্য এই একটাই কারণ – সব জায়গায় হাতের কাজের চোখজুড়ানো দেয়াল এবং ফটক। ভবনের ভিতরে ঠিক মাঝ বরাবর রয়েছে একটি পিলার যাকে কেন্দ্র করে বানানো হয়েছিল আকবরের বিচার সিংহাসন, এবং নীচে ছিল দর্শকের সমাগমের স্থান। যেই পিলারটির উপরে আকবর অবস্থান করতেন, সেটির নীচে রয়েছে অপূর্ব সুন্দর ইটের কারুকাজ, এবং রয়েছে আভিজাত্যের উপস্থিতি।

সৌখিন নবরত্নখচিত বিনোদন

এরপরে আসি বিনোদনের কথায়। সেকালে টেলিভিশন, রেডিও এর আবিষ্কার ছিল না বটে, কিন্তু মনোরঞ্জনের বেলায় জাঁহাপনা ছিলেন যথেষ্ট শৌখিন। দিওয়ান-এ-খাস নামক ভবনটি ছিল তাঁর বিশেষ  বিনোদনখানা যেখানে বসে নবরত্ন এবং তানসেনের মত শিল্পীর আবির্ভাব ঘটে। সম্রাট আকবর ছিলেন গুণী কলাকুশলীর বিশেষ প্রসংশক। তানসেনের গানের আসরের জন্য তিনি বানিয়েছিলেন বিশেষ বেদি, যেটি পানির মধ্যখানে উপস্থিত এবং বেদির চারপাশে চারটি সরু সংযোগস্থল। এছাড়া সম্রাট তাঁর অবসর ঘড়িতে উপভোগ করতেন পাশা খেলা, যেখানে অংশগ্রহন করতেন তাঁর শখানেক নারী গৃহকর্মী। প্রশাসনিক ভবনের পাশে একটি লাল ইটের তৈরি মহল ছিল যেটি ছিল পঞ্চতলা বিশিষ্ট, নাম তাঁর ‘পাঁচ মহল’। এই মহলটি আকবরের দুধ মাতা মহম আঙ্গা এর বিশ্রামঘর ছিল, এবং সবার উপরের তলায় তিনি মাঝেমধ্যে বিকাল বেলা ঠাণ্ডা বাতাসের ছোঁয়া উপভোগ করতেন অথবা বিভিন্ন নাচ-গানের আসর, আর আকবরের পাশা খেলা উপভোগ করতেন। নীচ তলাটি ছিল সবচেয়ে কারুকাজপূর্ণ।

ধর্মীয় ছোঁয়া সিকরির সর্বত্র

সম্রাট আকবর সব ধর্মেরই সমান কদরী ছিলেন। সিকরির পাশে রয়েছে জামে মসজিদ, যেটি সম্রাট আকবর স্বয়ং নির্মাণ আদেশ দিয়েছিলেন। মসজিদের আয়তন ছিল ৫৪০ ফিট লম্বা। এর প্রবেশের জন্য আছে সেই বুলন্দ দরওয়াজা। আকবরনামা মোতাবেক আকবরের জীবনব্যাপ্তিতে ৩ ধর্মের স্ত্রী এর উপস্থিতি পাওয়া যায়। তিনি তাঁর এই ৩ ধর্মের সঙ্গিনীর জন্য বানিয়েছিলেন ৩ ধর্মের স্থাপত্য শিল্পের ছাপে নির্মিত বাসস্থান এবং উপাসনা কেন্দ্র। মুসলিম স্ত্রী রুকাইয়া সুলতান বেগম যার সাথে আকবরের স্বল্প সময়ের বৈবাহিক জীবন ছিল। তাঁর জন্য ছিল মুসলিম স্থাপত্য শিল্প অনুকরণে নির্মিত একটি মহল। মহলের ভিতরে এবং বাহিরে রয়েছে নিখুঁত হাতের কাজ করা দেয়াল, পিলার এবং ছাঁদ। অন্দরমহলের বিভিন্ন জায়গায় মার্বেল পাথরের উপস্থিতি দেখা যায় । তাঁর জন্য  ছিল আমিষ ভোজী হেঁশেল ঘর।এই রুকাইয়া বিবি ছিলেন সম্রাট আকবরের শৈশবের খেলার সাথি, যাকে আকবর ছোট বেলা থেকেই পছন্দ করতেন। পরে বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু তাঁর গর্ভে কোন সন্তান আসেনি। আরেক সহধর্মিণী, রাজপুত বংশের রাজকন্যা এবং জয়পুরের রাজা মান সিং এর কন্যা যোধা বাই। কিন্তু আকবরনামা মোতাবেক আকবরের রাজপুত বংশের স্ত্রীর এর নাম হিসাবে যোধা বাই এর নামের উল্লেখ নেই। যা হোক, সিকরি অঙ্গনে যোধা বাই এর জন্য ও ছিল এক মহল এবং তাঁর পাশেই ছিল তুলসী গাছ সমেত একটি মন্দির। মহলের ছাঁদ ছিল বিশেষভাবে তৈরি যাতে করে গরমকালে সূর্যের তাপে ভিতরের পরিবেশ ঠাণ্ডা থাকে।  তাঁর জন্য ছিল বিশেষ শাকাহারি বা নিরামিশভোজী হেঁশেল ঘর। এই যোধা বাই এর গর্ভে আকবর তাঁর পুত্র সন্তান লাভ করেন সেই সূফী দরবেশ সেলিম চিশতী এর দোয়ায়। সম্রাট আকবরের একজন খ্রিস্টান সহধর্মিণী ও ছিলেন যার নাম ছিল মরিয়ম, কিন্তু বর্তমানে খুজে দেখলে সেই খ্রিস্টান মরিয়মের নামে মুসলিম পরিবর্তন দেখা যায় যার নাম মরিয়ম-উজ-জামান। তাঁর মহলে ছিল খ্রিস্টান ধর্মের স্পষ্ট ছাপ, অন্দর মহলে ছিল কারুকাজ পূর্ণ শয়ন ঘর, সাজঘর, উপাসনা করার জন্য কিছু জায়গা। যেহেতু তিনি খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী ছিলেন, তাঁর দুই হেঁশেলঘরেই অবাধ বিচরণ ছিল।

আকবরের শয়নঘর ছিল সবচেয়ে আলাদা। এখন দেখতে অন্ধকার কুঠরির মত মনে হলেও ইতিহাস শুনলে চোখে ভেসে উঠবে শৌখিনতায় মোড়ানো এক শয়নঘর। আকবর খর্বাকৃতি হওয়ার দরুন তাঁর শয়নঘরে প্রবেশের দরজাটি ছিল তাঁর দেহের মাপে বানানো। দরজার নিচেই ছিল একটি ছোট চৌবাচ্চা যাতে থাকতো গোলাপজল,  যেখানে সারাদিনের ক্লান্তির পর পদধুলা পরিষ্কার করে আকবর তাঁর কক্ষে প্রবেশ করতেন। মাঝখানে ছিল শয়ন পালঙ্ক, যার নিচে ছিল আরেকটি বড় চৌবাচ্চা, গরমকালে যেটা পানিপূর্ণ করা হত কক্ষের ভিতরের পরিবেশ শীতল করার জন্য। দেয়ালের মধ্যে ছোট ছোট খোপ ছিল মোমবাতি বসিয়ে ঘরকে আলকিত করার জন্য, উপরের দেয়ালে ছিল মোমবাতির ঝাঁর।

এক শতকের ফেলনা অন্য শতকের অমূল্য নিদর্শন

পনেরো বছরের নির্মাণ আর ৭ বছরের জীবনযাপন শেষে পর্যাপ্ত পানির অভাবে এই সুন্দর মহল প্রাঙ্গন কে পরিত্যাগ করা হলেও সময়ের পরক্রমায় এটি ভারতের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসেবে রূপ নেয়। সে আমলে যথেষ্ট পরিকল্পনা করে এই মহল প্রাঙ্গন নির্মাণ করা হলেও সেখানে থাকা যায়নি পানির অভাবে। কিন্তু তারপরেও এই ফতেহপুর সিকরি মুঘল স্থাপত্য শিল্পের এক অন্যতম নিদর্শন যেটি ইতিহাস কে সঙ্গে করে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে বছরের পর বছর।

সাঙ্গেমারমার বা শ্বেত মাজার

এবার আসি সেলিম চিশতীর দরগায়। সিকরি থেকে খানিকটা দূরে আছে এই মাজার। পূর্বে এটি লাল বেলে পাথর দিয়ে বানানো হয়েছিল যেটিকে পরে সংস্কার করে সাদা রঙে পরিবর্তন করা হয়। সাদা বর্ণের এই মাজারের ভিতরে রয়েছে সুফী চিশতীর দরগা শরীফ। সম্রাট আকবর সুফী চিশতীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এই মাজারের নির্মাণ করিয়েছিলেন। এই সুফীর ভবিষ্যৎবাণী আকবর পুত্র সন্তান লাভ করেন, যার নামকরণ এই সুফীর নামেই ‘সেলিম’ রাখা হয়েছিল, পরবর্তীতে তাঁর নাম জাহাঙ্গীর রাখা হয় এবং সেই নামানুসারেই আকবরের সিংহাসনে তাঁকে বসানো হয়। বলা হয়ে থাকে, এই মাজারে কোন মনের আশা নিয়ে নামাজ আদায় করলে সেই আশা পুরন হয়ে থাকে। এছাড়াও মাজারের জানালায় সুতা বাঁধারও রীতি আছে যার মাধ্যমে মনের আশা পূরণ হয়ে থাকে।

দূরদর্শনে ফতেহপুরের সিকরি

ফতেহপুর সিকরি বিপুল ঐতিহ্য এবং ইতিহাসের একটি জীবন্ত উদাহরণ। ভারতীয়রা তাদের এই নিদর্শন গুলোকে যথেষ্ট সম্মান করে এবং বিভিন্ন চলচ্চিত্র এবং ডকুমেন্টারির মাধ্যমে জায়গা গুলোকে সুন্দর ভাবে তুলে ধরে। ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা সুভাশ ঘাই ১৯৯৭ সালে পরদেশ  সিনেমাতে ফতেহপুর সিকরিকে সিনেমার গানে এবং বিভিন্ন দৃশ্যতে অনেক সুন্দর করে দেখিয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন ভিডিও দেখলে আমরা ঘরে বসেই ফতেহপুর সিকরি সম্বন্ধে জানতে পারব।

কন্টেন্ট রাইটারঃ ফাতেমা নজরুল স্নেহা

 

Porjotonlipi

2 comments