আগ্রা – যেটাকে সবাই আগ্রার বিখ্যাত তাজমহল এর শহর নামেই চিনে ৷ মোঘল সম্রাট শাহজাহান তার প্রয়াত স্ত্রী আরজুমান্দ বানু বেগম বা মুমতাজ বেগমের প্রতি স্মৃতিচারণ ও ভালোবাসা প্রদর্শন করতে গড়ে তোলেন এই ভালোবাসার নিদর্শন তাজমহল|
তাজের শহর আগ্রা
২১ বছরের দীর্ঘ সময় এবং ২০,০০০ শ্রমিকের সম্মিলিত প্রয়াসে ভালোবাসার এক অন্যরকম প্রমাণ হিসেবে রূপ নেয় শ্বেতপাথরের এই সুবিশাল মহল৷ তাজমহল নির্মাণে তৎকালীন ৩২ মিলিয়ন রুপি খরচ করা হয়েছিল বলে জানা যায়।
দিল্লী থেকে আগ্রার বিখ্যাত তাজমহল যাত্রা
আজ আমরা তুলে ধরবো আগ্রার বিখ্যাত তাজমহল এর ভ্রমণ গল্প। দিল্লী ভ্রমনের তৃতীয় দিনে বৃষ্টিভেজা সকালে আমরা রওনা দেই ভালবাসার নিদর্শন তাজমহল দেখার উদ্দেশ্যে। মহাসড়ক ধরে ৫-৬ ঘণ্টার ২২০ কিলোমিটার যাত্রা শেষ করে আমরা পৌঁছে যাই আগ্রা তে। যথারীতি, আমাদের ট্যুরের গাড়ি থেকে নেমে ইলেকট্রনিক যানে করে পৌঁছে গেলাম তাজমহল। বেলা ১২টা নাগাদ আমাদের প্রবেশ। টিকেটের গায়ে একটা নির্দেশনা লিখা ছিল যে ৩ ঘণ্টা অতিক্রম হবার পর পরবর্তী সময়ের জন্য অতিরিক্ত চার্জ ধরা হবে। আমার কাছে ব্যাপার টা একটু অবাক লেগেছিল কারণ ৩ ঘণ্টা একটা জায়গা ঘুরে দেখার জন্য অনেক বেশি সময়, যেহেতু অন্যান্য জায়গা আমরা ১ ঘণ্টার মধ্যে ঘুরে দেখে শেষ করেছি। কিন্তু ভাবিনি যে টিকেটের কথাই বাস্তবে রূপ নেবে। কারণ পুরো তাজমহল ঘুরে বাইরে বেরিয়ে আসতে ঘড়ি ধরে ৩ ঘণ্টা সময়ই লেগেছে।
তাজমহলের আকর্ষণ
এক পা দুপা করে আগাতে আগাতে চলে আসল প্রধান ফটক। মসজিদের মত দেখতে লালপাথরের বিশাল ফটক এর ভিতর দিয়ে যাওয়ার মধ্যে অন্ধকার থেকে চোখে পরে ওই দূরে হাজার বছরের সৌন্দর্যের দাম্ভিকতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভালবাসার অবিশ্বাস্য স্মরণীয় ভাস্কর্য শ্বেত পাথরের তাজমহল। প্রথমে নিজ চোখে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন বইয়ের পৃষ্ঠায়, টেলিভিশনের রুপালি পর্দায় যে তাজমহল দেখেছি, সেই তাজমহলকেই এখন নিজ চোখের সামনে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছি। সেই সাদা মহলের দিকে তাকিয়ে থেকে যেরকম একটা রোমহর্ষক অনভুতি মনকে নাড়া দিয়েছিল, সেই অনভুতির কথা মনে করে এখনও ঠিক সেরকম টাই অনুভব হয়, যেটা শত লাইন লিখেও বুঝান যাবে না।
আমরা যখন ধীর পায়ে মহলের দিকে আগাচ্ছি, তখন আকাশে কালো মেঘের জমাট বাধে এবং গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়। বৃষ্টিতে ভিজে তাজমহল ঘুরে দেখব ? ভাবছিলাম এই বৃষ্টি তে বেশিক্ষণ ভিজলে তো ঠাণ্ডা লাগার উপক্রম! এগুলা ভাবতেই খুব রাগ হচ্ছিল যে আমরা বৃষ্টি তে ভিজে তাজমহল ঘুরে দেখেছি। কিন্তু, এতদিন পরে এসেও মনে হয় যে এর চেয়ে স্বর্গীয় অনভুতি মনে হয় যেন আর নেই। কারণ বৃষ্টিতে ভিজে মনকে নরম করে ধবধবে সাদা মহলের সৌন্দর্য ভক্ষন না করলে হয়ত পুরো আনন্দটাই ফিকে হয়ে যেত। ধুসর আকাশের নিচে সফেদ তাজমহল – সে যেন এক অন্যরকম তাজমহল।
আগ্রার বিখ্যাত অপরূপ তাজমহল
বিশাল সরু বাগানের পথ ধরে মহলের দিকে যাত্রা। মাজার অংশ এবং দরজার মাঝামাঝি অংশে এবং বাগানের মধ্যখানে একটি উঁচু মার্বেল পাথরের পানির চৌবাচ্চা বসান আছে এবং উত্তর-দক্ষিনে একটি সরলরৈখিক চৌবাচ্চা আছে যাতে তাজমহলের প্রতিফলন দেখা যায়। তাজমহল মূলত একটি রাজকীয় সমাধি, যার নির্মাণশৈলীতে পারস্য, তুরস্ক, ভারতীও, এবং ইসলামি স্থাপত্যশিল্পের সংমিশ্রণ দেখা যায়। দেখতে সাদা হলেও তাজমহল নির্মাণে শ্বেতপাথর ছাড়াও অন্যান্য দেশ হতে নিয়ে আসা বিভিন্ন পাথরের ব্যবহার সম্পর্কে জানা যায়, যার সম্পর্কে তাজমহল জাদুঘরে বিস্তারিত ভাবে বর্ণিত আছে। উইকিপিডিয়া ঘুরে আসলেও এই পাথরগুলর আগমন সম্পর্কে জানতে পারব।
বৃষ্টিভেজা পানিতে সিক্ত হয়ে যতই তাজমহলের দিকে আগাচ্ছি, এর সৌন্দর্য যেন ততই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। মূল মহলের চারপাশে বেশ লম্বা ব্যারিকেড দেয়া ছিল যাতে কেউ তাজমহলের দেয়াল স্পর্শ করতে না পারে। তাজমহল এর এতই উচ্চতা, যে কাছে গেলে নিজেকে খুবই ক্ষুদ্র মনে হয়। আর মহলের চারপাশের সবগুলো দরজার নিচ থেকে উপর পর্যন্ত লম্বাটে কালো রঙের আরবী ক্যালিগ্রাফি খোঁদাই করে লিখা। নির্মাণের এত হাজার বছর পরেও মহলের দেয়াল সামনে গিয়ে দাঁড়ালে দেখা যায় দেয়ালগুলো চিকচিক করছে। সাধারন টিকেটে ঘুরে দেখার ব্যাপ্তি এতটুকই।
কেমন দেখতে আগ্রার বিখ্যাত তাজমহল এর ভেতর
যদি মহলের ভিতরে যেতে হয়, তবে বিশেষ টিকেট কেটে যেতে হয়। আমরা সেটাও গিয়েছি, এবং বলব যে সেটাও একটা অভূতপূর্ব অনুভুতি। বাইরের পরিবেশ থেকে ভিতরের পরিবেশ পুরোটাই অন্যরকম। বাইরে যেরকম মানুষের মিলনমেলা আর হইচই, অন্দরমহলে অতটাই নির্জন এবং শান্ত। ভিতরে ঠিক গোলাকার গম্বুজ বরাবর রয়েছে সম্রাট শাহজাহান এবং স্ত্রী মুমতাজ বেগমের সমাধি। সেখানে ঢুঁকে ট্যুর গাইড ছাড়া অন্য কারও কথা বলা নিষিদ্ধ। সমাধি এলাকা পুরোটাই নিশ্চুপ যে কারণে ঘুরে দেখতে বেশি সময় লাগেনি।
সৌন্দর্যের সাথে জড়িয়ে আছে যে ইতিহাস
তাজের ঠিক পিছনেই রয়েছে যমুনা নদী। ডান পাশে এবং বাঁ পাশে রয়েছে দেখতে হুবহু একরকম ২টি মসজিদ ন্যায় ইমারত। পূর্ব দিকে অর্থাৎ ডানদিকে যেটি রয়েছে সেটি হল একটি মসজিদ এবং বামদিকের ইমারতটি একটি সাবেক মেহমানখানা যার নাম হল জওয়াব যার উদ্দেশ্য ছিল ভারসাম্য রক্ষা করা। এটি পূর্বে মেহমান দের বিশ্রামখানা হিসাবে ব্যাবহার হত, পরবর্তীতে মসজিদ হিসেবে ব্যাবহার হয় যেখানে ৫৬৯ জন মুসল্লির নামাজ আদায়ের সুযোগ রয়েছে।
দেশীয় ঐতিহ্য রক্ষায় পরিচ্ছন্ন কর্মীদের অবদান
তাজমহল যেখানে অবস্থিত, তার ১ কিলোমিটার দূরে থেকে সকল যানবাহন এর প্রবেশ নিষিদ্ধ, শুধুমাত্র ইলেক্ট্রনিক যানে করে সেখানে যেতে হয়। কারণ একটাই, তাজমহলের ধবধবে শ্বেত সৌন্দর্যকে ধরে রাখা। বলা হয়ে থাকে, তাজমহলের এখন যে রঙ বিদ্যমান তার অনেক বছর আগে এর চেয়েও সাদা ছিল। তাহলে একবার চিন্তা করে দেখা যাক, এখনই এরকম সাদা, যখন তাজের নির্মাণ শেষ হয়, তখন কিরকম দেখতে ছিল ? ভাবার বিষয় বটে। কয়েক বছর আগে আগ্রা তে কলকারখানা নির্মাণ করা হলে, সেই কারখানার বিষাক্ত ধোয়ায় তাজমহলে কালো আবরণ পরে, যে কারণে সেই এলাকায় সেখানে সকল ধরনের কারখানা স্থাপনে সম্পূর্ণ নিশেধাজ্ঞা জারি করা হয়, এবং শুধু মাত্র স্থানীয় বাসিন্দা ছাড়া সকল প্রকার যানের প্রবেশ নিষিদ্ধ। ভারতীও পর্যটন কেন্দ্র গুলো ঘুরে দেখলে সেগুলর সৌন্দর্যের পাশাপাশি আরেকটা বিষয় দেখে চক্ষু চড়কগাছ হবার উপক্রম, সেটা হল নিদর্শনগুলোকে ঝকঝকে তকতকে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার কারনেই নিদর্শন গুলো এখনও সুন্দরভাবে টিকে আছে।
তাজমহল এর সৌন্দর্য অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সেখানকার চেষ্টা একটু ভিন্নরকমের। নীচ থেকে যখন তাজমহলের কাছে যাওয়া হবে, তখন শু কভার পায়ে পরে অথবা খালি পায়ে পুরোটা ঘুরে দেখতে হবে, কারণ হল মহল প্রাঙ্গন কে সফেদ এবং পরিচ্ছন্ন রাখা। ঘুরে বের হওয়ার সময় দেখলাম পরিচ্ছন্ন কর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা করে ভিতর প্রাঙ্গন সাফাই করছে, দেখে খুব ভাল লাগল যে তাদের নিদর্শন গুলকে টিকিয়ে রাখতে কত কিছু অবলম্বন। এছাড়াও, বাহিরের বাগান এবং পিছনের গাছাপালা এবং প্রাঙ্গন পরিষ্কার করতে নিয়োজিত আছে অনেক কর্মী।
কেন এই তাজ এক অন্যরকমের পর্যটন আকর্ষণ ?
স্থানীয় আগ্রাবাসী রা বলে থাকেন যদি তাজমহলের প্রকৃত শ্বেত সৌন্দর্য উপভোগ করতে হয়, তাহলে পূর্ণিমার রাতে দেখতে আসার জন্য। কারণ পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় শ্বেতপাথরের সেই চিকচিক রূপটি আরও প্রত্যক্ষ হয়ে মানুষের নজরে ধরা দেয়। কিন্তু রাতের বেলা তাজমহল প্রাঙ্গনে প্রবেশ সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ।
প্রতিবছর তাজমহল ঘুরতে আসা বিশ্বব্যাপী পর্যটকসংখ্যা ২ থেকে ৩ মিলিয়ন যার মধ্যে ২০০,০০০ পর্যটকই বিদেশি। ১৯৮৩ সালে সৌন্দর্যের এই সার্বজনীন প্রতীক ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যপূর্ণ নিদর্শনের তালিকায় প্রবেশ করে এবং পৃথিবীর সপ্তমাশ্চর্যের একটি এই নিদর্শনকে বলা হয়েছিল ‘বিশ্ব ঐতিহ্যের সার্বজনীন প্রশংসিত শ্রেষ্ঠকর্ম’। এই ধরণের রক্ষণাবেক্ষণ ও পর্যাপ্ত প্রচার থাকলে আমাদের দেশের প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনগুলো বিদেশি পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে।
কন্টেন্ট রাইটারঃ ফাতেমা নজরুল স্নেহা
[…] আগ্রাকে বিদায় জানিয়ে আমাদের যাত্রা আরেক শহর […]
[…] শতাব্দীর শেষার্ধে আগ্রার তাজমহলের অপরুপ নির্মাণশৈলীকে সামনে রেখে […]