এই ভারতবর্ষ দক্ষিন এশিয়ার দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ জনসংখ্যার দেশ। আয়তনের তালিকায় সপ্তম স্থান অধিকার করে আছে এই দেশ। এই দেশটি শুধু বৃহৎই নয়, এর সর্বত্র ছড়িয়ে আছে সৌন্দর্য ও ইতিহাসের ছোঁয়া। স্বল্প সময়ের ভ্রমণ হলেও এই স্বল্প কিছুদিনের স্মৃতি মনের গভীরে দাগ কেটে আছে।
ইতিহাস সমৃদ্ধ ভারতবর্ষ ভ্রমণ
গত ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে পরিবারের সাথে এই ভারতবর্ষ ভ্রমণ করতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। দুবছর পরেও সেই স্মৃতি যেন এখনও তাজা। ১৪ দিনের এই স্বল্প ভ্রমণের কথা মনে করেই এই লেখা। আকাশ পথে না গিয়ে আমরা রেলগাড়িকে বেঁছে নিয়েছি, যাতে করে আমাদের ভারতবর্ষ ভ্রমণ হয়ে উঠেছে আরও উপভোগ্য।
কলকাতা
২রা আগস্ট সকালে ঢাকা সেনানিবাস রেলস্টেশন থেকে সকাল ৮টা নাগাদ ট্রেনের যাত্রা শুরু হয়। ভ্রমনের প্রথম গন্তব্য ছিল কলকাতা। ৮ ঘণ্টার যাত্রা শেষ করে বিকাল ৪ টায় কলকাতার চিতপুর স্টেশন এ অবতরন। এরপর সেখান থেকে কয়েক মিনিটের দূরত্বে মেট্রো স্টেশন। হলুদ ট্যাক্সিতে চড়ার পর মুহুর্তেই শুরু হয় ঝুম বর্ষণ, ট্যাক্সিতে বসে সেই মুহুর্তের কথা মনে করলে আজও মনে হয় এইত সেদিনের কথা। স্টেশন পার হয়ে উঠলাম হোটেলে।
ঘণ্টা খানিকের বিশ্রাম বিরতির পর শুরু হয় ঘোরার পর্ব। হোটেল থেকে বেরিয়ে কয়েক মিনিট হেঁটে উঠলাম কলকাতার সেই লোকাল বাসে। নীল-হলুদ বর্ণের সেই বাস – সিনেমাতে যেরকম দেখায়, ঠিক সেরকম। মিনিট দশেক পর নামলাম কলকাতার বিখ্যাত নিউ মার্কেটের সামনে। কলকাতা গিয়ে আমার কাছে সেরকম কোন পার্থক্য নজরে পরেনি। ঠিক যেন ঢাকা শহরের মতই – লোকজনের কোলাহল আর প্রচণ্ড রকমের ভিড়। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল শুধুই ঘুরে দেখা। তাই নিউ মার্কেট থেকে কেনাকাটার কোন প্রয়োজন পরেনি। মার্কেট ঘুরে হোটেল ফিরতি যাত্রার মধ্যে চোখে পরে টং দোকানের চা। সুন্দর, পরিষ্কার, ছোট মাটির পেয়ালায় করে মজাদার চা পরিবেশন। প্রথম দিনের যাত্রার ব্যাপ্তি এতটুকই ছিল।
পরদিন সকালে প্রথম গন্তব্য ভিক্টোরিয়া মেমরিয়াল। মেট্রোরেল এ করে পৌঁছে গেলাম ময়দান, সেখান থেকে বেশ কিছু পথ হেঁটে ইডেন গার্ডেন খেলার মাঠ পার হয়ে পৌঁছালাম ভিক্টোরিয়া মেমরিয়ালে। রাণী ভিক্টোরিয়ার ২৫ বছর ভারত শাসনের সময় নির্মাণ করা হয় ভবনটি। রাজস্থানের সাদা মকরানা মার্বেল দিয়ে তৈরি ভবনের অবকাঠামো। এই জাদুঘরের ভিতরে রয়েছে ব্রিটিশ শাসনের কিছু চিহ্ন, রয়েছে লর্ড ক্লাইভ এর মূর্তি, নীল চাষিদের নীল জ্বাল দেয়ার ভারী কড়াই, তাঁত যন্ত্র। রয়েছে রাণী ভিক্টোরিয়ার রাজ্যাভিষেক, রাজপুত্র আলবার্ট এর সাথে বিবাহ, প্রিন্স অফ ওয়েলস (ষষ্ঠ এডওয়ার্ড) এর কিছু তৈলচিত্র।
ভারতের সকল বিশালাকার স্মৃতিস্তম্ভের মধ্যে ভিক্টোরিয়া মেমরিয়াল একটি, যার পুরোটা ঘুরে দেখতে সময় লাগে ঘণ্টাখানেক। এরপর কলকাতার কিছু জায়গা ঘুরে দুপুরে খাওয়াদাওয়া পর্বের পর বিকালের ট্রেনে আমাদের দিল্লীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু।
দিল্লী – জাতীয় রাজধানি অঞ্চল
দুই ভাগে বিভক্ত ভারতের সাবেক রাজধানী, যার সরকারি নাম দিল্লী জাতীয় রাজধানী অঞ্চল – ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে দিল্লী যমুনা-গঙ্গার উপত্যকার সংযোগস্থল। দিল্লীর আয়তন ১,৪৮৪ বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৬৩ লক্ষ।
১৭ ঘণ্টার রেলযাত্রার সমাপ্তি ঘটিয়ে পুরান দিল্লীতে আমাদের আগমন। স্টেশন থেকে মিনিট দশেকের দূরত্বে পাহাড়গঞ্জ নামক জায়গায় ছিল আমাদের হোটেল। বিশ্রাম পর্ব শেষ করে শুরু হয় ঘোরার পালা। তার আগে মধ্যাহ্নভোজের জন্য বরাদ্দ কিছু সময়। চলে গেলাম সেখানকার স্থানীয় এক খাবারের হোটেলে, অর্ডার দিলাম বহুল পরিচিত সেই ভারতীয় ‘থালী’, যার মধ্যে ছিল লুচি, ভাত, পনিরের ঝোল, ফুলকপির ভাজি এবং তরকারি। মশলার বহুল ব্যাবহার থাকলেও শরীর খারাপ করার কোন সুযোগ নেই কারণ হোটেলগুলোর পরিবেশ যথেষ্ট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ভূরিভোজন পর্বের পর প্রথম গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা।
কুতুব মিনার
পুরাতন দিল্লীতে অবস্থিত এই মিনারটি বিশ্বের সর্বোচ্চ ইটনির্মিত মিনার, যার উচ্চতা ৭২.৫ মিটার। মিনারটি কুতুব- উদ- দিন আইবাক ১১৯৩ সালে স্থাপন করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল দিল্লির সর্বশেষ হিন্দু শাসকের বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় লাভ।
মিনারটিতে পাঁচটি ভাগ লক্ষ করা যায় যেগুলো দেখতে অনেকটা বারান্দার মত। পুরো মিনারটির স্তরে স্তরে রয়েছে হাতের নিখুঁত কাজ এবং খোঁদাই করা আরবী ক্যালিগ্রাফি। নিচ থেকে চওড়া হয়ে উপরের দিকে উঠতে উঠতে মিনারটি সরু আকার ধারণ করেছে। মিনারের নামটিতে মুসলিম উপস্থিতি থাকলেও নির্মাণের পর থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত মিনারটি ‘রাজা পৃথ্বীরাজ মন্দির’ হিসাবে প্রচলিত ছিল। ১৯৯৩ সালে এই কুতুব মিনার ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান’র তালিকায় প্রবেশ করে। মিনারের আশে পাশে আরও কিছু প্রাচীন এবং মধ্যযুগীও স্থাপনা ও তার ধ্বংসাবশেষ রয়েছে যা কুতুব মিনার কমপ্লেক্স নামকরণ পেয়েছে। প্রখ্যাত সুফী কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকীর নামানুসারে এর নাম রাখা হয়। মিনার কমপ্লেক্সের ভিতরের দিকে গেলে ধ্বংসাবশেষগুলো দেখা যায় যেগুলো এখনও অনেক ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দণ্ডায়মান হয়ে আছে। কিছু স্তম্ভের কাছে গেলে বিভিন্ন কারুকার্য এবং আরবী ক্যালিগ্রাফি দেখা যায় যেগুলো নীচ থেকে উপর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। উইকিপিডিয়া ঘুরে দেখলে কুতুব মিনার সম্পর্কে চমৎকার সব তথ্য সম্পর্কে জানা যায়।
সংসদ ভবন ও ইন্ডিয়া গেট
কুতুব মিনারের পর আমাদের যাত্রা ভারতের সংসদ ভবন এবং ইন্ডিয়া গেট। সেই পর্যন্ত যেতে বিকাল হয়ে যাওয়ায় সংসদ ভবনের সামনে চমৎকার সূর্যাস্ত উপভোগ করতে পেরেছিলাম। বিপুল পরিমাণ সিকিউরিটির কারণে ভবন প্রাঙ্গনে বেশিক্ষণ দাঁড়ানোর সুযোগ হয়নি। এরপরে সেখান থেকে বেশ খানিকটা পথ হেঁটে আমরা যাই ইন্ডিয়া গেট, যেখানে যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে যায়।
সন্ধ্যা থেকে ইন্ডিয়া গেট এক অন্যরকম রূপ ধারণ করে। আলোকসজ্জা দিয়ে পুরো ইন্ডিয়া গেটকে ভারতীও পতাকার রঙে রাঙিয়ে তোলা হয়, সে এক অভূতপূর্ব অনভুতি। পর্যটকদের জন্য বলবো, যদি দিল্লি ঘুরতে গিয়ে ইন্ডিয়া গেট ঘুরতে যান তবে অবশ্যই সন্ধার সময়টাকে বেছে নিবেন তাহলে বেশি উপভোগ করতে পারবেন।
ভারতের সর্বত্র রয়েছে সবুজের ছোঁয়া, চারিদিকে সতেজ, শ্যামল গাছগাছালির উপস্থিতি। সংসদ ভবন এবং ইন্ডিয়া গেটের সেই এলাকায় গেলে সেই চিত্র এক ভিন্ন রূপে ধরা দেয়।
পুরানা কিলা এবং হুমায়নের মকবরা
দ্বিতীয় পর্বে যাওয়া হয় আরও দুইটি ইতিহাস সমৃদ্ধ দুইটি স্থান পুরানা কিলা এবং হুমায়নের মকবরা। পুরানা কিলা নয়া দিল্লিতে যমুনা নদীর পাড়ে অবস্থিত যেটি আফগান শাসক শের শাহ এর শাসনামলে ১৫৩৮ থেকে ১৫৪৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে নির্মাণ করা হয়। কিলাতে প্রবেশ করার জন্য ৩টি বিশাল দরজা রয়েছে যে কারণে এর দেয়ালগুলো বেশ উঁচু।
কিলা প্রাঙ্গনের ভিতরে একটি দোতলাবিশিষ্ট অষ্টগম্বুজ মসজিদ রয়েছে। হিন্দু সাহিত্য মোতাবেক এই কিলা ইন্দ্রপ্রস্থে অবস্থিত যেটি একসময় পাণ্ডবের বিশাল রাজধানী ছিল। বলা হয়ে থাকে, মুঘল বাদশা হুমায়নের মৃত্যু কিলার ভিতরে অবস্থিত একটি ছোট ভবন থেকে সূর্যাস্ত দেখে নামার সময়ে দুর্ঘটনাবশত পা পিছলে পরে গিয়ে হয়। ভারতের সবগুলো ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো অনেক বড় আয়তনের জায়গা নিয়ে বানানো, যে কারণে পুরোটা ঘুরে ১ ঘণ্টার বেশি সময় লাগে।
এরপরের গন্তব্য ছিল হুমায়ুনের মকবরা বা হুমায়ুনের সমাধিসৌধ। পুরানা কিলার খুব কাছেই এটি অবস্থিত। মৃত্যুর নয় বছর পর হুমায়ুনের স্ত্রী হামিদা বানু বেগম পারসিক স্থপতি মির্জা গিয়াস দ্বারা তার সমাধিটি বানিয়ে থাকেন। ১৫৬৫ সাল থেকে শুরু করে ১৫৭২ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৭বছর এর নির্মাণকাজের ব্যাপ্তি। সে আমলের ১৫ লক্ষ টাকা খরচ করে এটি নির্মাণ করা হয়। এই মকবরাই ভারতের প্রথম ‘উদ্যান সমাধিস্থল’।
ভারতের বিশাল স্থাপনাগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড় লাল বেলেপাথরের স্থাপনা। এটিও ১৯৯৩ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান’র তালিকায় প্রবেশ করে। সমাধিটি দেখতে অনেকটা মসজিদ এর মত। এর বিশাল গোলাকার গম্বুজের ঠিক নীচ বরাবর রয়েছে হুমায়নের মাজার। পাশের একটি ঘরে রয়েছে ছোট ছোট বেশ কয়েকটি স্মৃতিস্তম্ভ। মকবরার পাশে অবস্থান করছে ঈশা খাঁ নির্মিত একটি মসজিদ যেটি ১৫৪৭ এ নির্মিত।
বাকিটা পরবর্তী পর্বে…
কন্টেন্ট রাইটারঃ ফাতেমা নজরুল স্নেহা
Add comment