এই দেশে নদী তো অনেক আছে কিন্তু ব্রহ্মপুত্র নদ এর গুরুত্ব যেন একটু অন্য রকম। বাঙালীকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে নদীমাতৃক এই বাংলাদেশের প্রায় সবকয়টি নদী।
বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্র নদ
ব্যাপক টান কাজ করে নদী নিয়ে। গ্রীষ্মের কড়া রোদে যেমন নদীতে একটি ঝাঁপ সকল ক্লান্তি এবং গরম দূর করে দেয় ঠিক তেমনিই বর্ষায় বৃষ্টির টিপ টিপ ফোঁটা একে করে তোলে মনোমুগ্ধকর।
ব্রহ্মপুত্র নদ এর পরিচিতি
ব্রহ্মপুত্র নদ এশিয়া মহাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নদ। সংস্কৃত ভাষায় ব্রহ্মপুত্রের অর্থ হচ্ছে “ব্রহ্মার পুত্র”। ব্রহ্মপুত্রের পূর্ব নাম ছিল লৌহিত্য। নদটি বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে পরিচিত যেমন অসমীয়ায়: লুইত, ব্ৰহ্মপুত্ৰ নৈ ইত্যাদি।
বিস্তৃতি
দেশসমূহঃ
চীন, ভারত, বাংলাদেশ
রাজ্যসমূহঃ
আসাম, অরুণাচল প্রদেশ,
তিব্বত
উপনদীঃ
বামদিকে-
দিবাং নদী, লোহিত নদী, ধানসিঁড়ি নদী
ডানদিকে-
কামেং নদী, রায়ডাক নদী, জলঢাকা নদী, ধরলা নদী, তিস্তা নদী
নগরঃ
গুয়াহাটি,তেজপুর,শিলঘাট
উৎসঃ
শিমায়াঙ-দাঙ হিমবাহ [১]
অবস্থান-
হিমালয়, চীন
উচ্চতা-
৫,২১০ মিটার (১৭,০৯৩ ফিট)
– স্থানাঙ্ক
৩০°২৩′ উত্তর ৮২°০′ পূর্ব
মোহনা
বঙ্গোপসাগর
– অবস্থান
গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ, বাংলাদেশ
– উচ্চতা
০ ফিট (০ মিটার)
– স্থানাঙ্ক
২৫°১৩′২৪″ উত্তর ৮৯°৪১′৪১″ পূর্ব
দৈর্ঘ্য
২,৮৫০ কিলোমিটার (১,৭৭০ মাইল) [১]
অববাহিকা
৬,৫১,৩৩৪ বর্গকিলোমিটার (২,৫১,৫০০ বর্গমাইল)
নদ এর উৎপত্তি
ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তি হিমালয় পর্বতমালার কৈলাস শৃঙ্গের নিকট জিমা ইয়ংজং হিমবাহে, যা তিব্বতের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত।[৩] জাঙপো নামে তিব্বতে পুর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে এটি অরুণাচল প্রদেশে ভারতে প্রবেশ করে যখন এর নাম হয়ে যায় সিয়ং। তারপর আসামের উপর দিয়ে দিহাঙ নামে বয়ে যাবার সময় এতে দিবং এবং লোহিত নামে আরো দুটি বড় নদী যোগ দেয় এবং তখন সমতলে এসে চওড়া হয়ে এর নাম হয় ব্রহ্মপুত্র। ব্রহ্মপুত্র হিমালয় পর্বতের কৈলাস শৃঙ্গের নিকটে মানস সরোবর থেকে উৎপন্ন হয়ে তিব্বত ও আসামের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ময়মনসিংহের দেওয়ানগঞ্জের কাছে ব্রহ্মপুত্র দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বাঁক নিয়ে ময়মনসিংহ জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভৈরববাজারের দক্ষিণে মেঘনায় পড়েছে।
১৭৮৭ সালে ভূমিকম্পের কারণে ব্রহ্মপুত্র নদীর তলদেশ উঠিত হবার কারণে এর দিক পরিবর্তিত হয়ে যায়। ১৭৮৭ সালের আগে এটি ময়মনসিংহের উপর দিয়ে আড়াআড়ি ভাবে বয়ে যেত। পরবর্তিতে এর নতুন শাখা নদীর সৃষ্টি হয়। যা যমুনা নামে পরিচিত। উৎপত্তিস্থলকে এর দৈর্ঘ্য ২৮৫০ কিলোমিটার। ব্রহ্মপুত্র নদীর সর্বাধিক প্রস্থ ১০৪২৬ মিটার (বাহাদুরাবাদ)। এটিই বাংলাদেশের নদীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছে। ব্রহ্মপুত্রের প্রধান শাখা হচ্ছে যমুনা। এক কালের প্রশস্ত ব্রহ্মপুত্র নদ বর্তমানে শীর্ণকায়, দূষণে ভরপুর।
হিন্দু পুরাণ মতে এর উৎস
ব্রহ্মপুত্র নদের উৎস নিয়ে তিব্বতি এবং ভারতীয় পুরাণে বেশ কিছু কাহিনী বর্ণিত রয়েছে। তিব্বতিরা বিশ্বাস করে, পৃথিবীর বুকে মানুষের বসতি শুরু হওয়ার বহু বছর আগে চাং টান নামক একটি মালভূমিতে এক সুবিশাল হ্রদের অস্তিত্ব ছিল। তখন বোধিসত্ত্ব নামক এক স্বর্গীয় অস্তিত্ব এই অঞ্চলে আসন্ন সকল মানুষের জন্য এই পানির প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরে হিমালয়ে দিয়ে এই পানি নির্গমনের একটি পথ তৈরি করে দেন। সেই পথ দিয়ে হ্রদের পানি প্রবল স্রোতে সাংপো নদী হয়ে ভূমিতে প্রবাহিত হতে থাকে। তারা এই নদীর পানিকে অত্যন্ত পবিত্র হিসেবে বিবেচনা করে। অপরদিকে হিন্দু পুরাণ মতে, ঋষি শান্তনুর স্ত্রী অমোঘার গর্ভে স্রষ্টা ব্রহ্মার একটি পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। সেই পুত্র একটি জলপিণ্ড হিসেবে জন্ম নিয়েছিল। ঋষি শান্তনু এই পুত্রকে কৈলাস, গন্ধমাদনা, জারুধি, সম্বর্তক নামক চারটি পর্বতের মাঝে রেখে আসেন। সেখানে এই জলপিণ্ড ‘ব্রহ্মকুণ্ড’ নামক হ্রদে পরিণত হয়। ওদিকে ত্রেতা যুগে বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরামের জন্ম হয়। পিতা মুণি জমদগ্নির নির্দেশে তিনি তার মাকে হত্যা করেছিলেন। মাতৃহত্যার মতো গুরুপাপের কারণে তার হাতে মারণাস্ত্র কুঠারটি আঠার মতো লেগে যায়। কোনোভাবেই সেই কুঠারকে হাত থেকে ছাড়াতে না পেরে পিতার কাছে যান তিনি। পিতা তাকে জানান মাতৃহত্যার মতো পাপের কারণে এই কুঠার তার হাত ছাড়ছে না। জমদগ্নি মুণি পরশুরামকে তীর্থযাত্রা করতে বলেন। পাপমোচনের লক্ষ্যে তিনি তীর্থযাত্রা করেন। একপর্যায়ে তিনি হিমালয়ের সেই ব্রহ্মকুণ্ড হ্রদে স্নান করেন। এর ফলে তার পাপমুক্তি হয় এবং কুঠার হাত থেকে নেমে আসে। এই ঘটনায় তিনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। এরপর চিন্তা করলেন, এমন স্বর্গীয় পানি সকলের জন্য সহজলভ্য করা প্রয়োজন। তিনি কুঠার দিয়ে পাহাড়ের একপাশ ভেঙে দেন। এর ফলে হ্রদের পানি হিমালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এরপর তিনি লাঙ্গল দিয়ে মাটি কর্ষণ করে সেই জলধারাকে প্রবাহিত হওয়ার পথ গড়ে দিতে থাকেন।
সুদূর হিমালয় থেকে হাল টানতে টানতে ক্লান্ত পরশুরাম বিশ্রাম করার জন্য লাঙ্গল থামান বর্তমান নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দ অঞ্চলে। মূলত, এই কারণেই অঞ্চলটির নাম ‘লাঙ্গলবন্দ’ রাখা হয়েছে। সেই থেকে ব্রহ্মপুত্রের ধারা হিমালয় থেকে লাঙ্গলবন্দ পর্যন্ত প্রবাহিত হচ্ছে বলে বিশ্বাস করা হয়। এই জলধারা পরবর্তীতে মেঘনার সাথে মিশে যায়। সনাতন ধর্মানুসারীদের নিকট এই কারণে ব্রহ্মপুত্রের পানি অত্যন্ত পবিত্র বলে গণ্য হয়। প্রতিবছর লাঙ্গলবন্দ ঘাটে বিভিন্ন দেশ থেকে হিন্দুরা এসে স্নান করার মাধ্যমে পাপমুক্ত হন। ব্রহ্মার সন্তান থেকে এই নদের জলধারা এসেছে বলে এর নাম হয় ব্রহ্মপুত্র নদ।
বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র নদ এর অববাহিকা
আসামের উপত্যকায় ৭২০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে এই নদ গারো পাহাড়কে ঘিরে প্রবাহিত হয়। এরপর ভবানীপুর এলাকায় কুড়িগ্রাম জেলার উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বাংলাদেশের বুকে ব্রহ্মপুত্র নদের প্রবাহ অন্যান্য দেশের তুলনায় সংক্ষিপ্ত। এদেশে একে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ হিসেবে ডাকা হয়। চিলমারী অতিক্রম করে এই নদ তিস্তা নদীর সাথে মিলিত হয়। এরপর দক্ষিণে এটি যমুনা নদী হিসেবে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনা নদী প্রবাহিত হয়ে গোয়ালন্দ ঘাটের নিকটে পদ্মার সাথে মিলিত হয়েছে। আর ব্রহ্মপুত্রের মূল ধারা জামালপুর এবং ময়মনসিংহ জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এই ধারা ভৈরব বাজারে মেঘনার সাথে মিলিত হয়েছে। চাঁদপুর জেলায় মেঘনা এবং ব্রহ্মপুত্রের ধারার সাথে মিলিত হয় পদ্মা। এরপর মেঘনা নদী হিসেবে তা দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।
২০০ বছর পূর্বে ১৭৮৫ সালে রেনেলের তৈরি মানচিত্রে ময়মনসিংহের উপর দিয়ে নদের গতিপথ চিহ্নিত হয়েছে। তখন এটিই ব্রহ্মপুত্রের মূল গতিপথ ছিল। ১৭৮২-৮৭ সময়কালের মধ্যে সংঘটিত ভূমিকম্প এবং ভয়াবহ বন্যার ফলে এর গতিধারা বদলে যায়। ব্রহ্মপুত্রের পানি তখনকার জোনাই খালের সাথে মিলিত হয়ে গঠিত হয় যমুনা নদী। গঙ্গা (পদ্মা), ব্রহ্মপুত্রসহ বেশ কয়েকটি নদী নিয়ে বাংলাদেশ এবং ভারতের বিস্তৃত ৩৫৫ কিলোমিটার অঞ্চলজুড়ে গঠিত হয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ।
ব্রহ্মপুত্র নদ না নদী
নদ এবং নদীর মধ্যে পার্থক্য জিজ্ঞাসা করা হলে প্রায়ই যে উত্তর পাওয়া যায় তা হচ্ছে, নদীর শাখা আছে কিন্তু নদের নেই। বহুল প্রচলিত হলেও এই উত্তর সঠিক নয়। যেমন ধরা যাক ব্রহ্মপুত্রেরই কথা। নদ হিসেবে পরিচিত এই ব্রহ্মপুত্র থেকে যমুনা, শীতলক্ষ্যা, বানার, সাতিয়া নামক শাখা নদীর উৎপত্তি হয়েছে। সংজ্ঞা অনুযায়ী কিন্তু ব্রহ্মপুত্রকে নদী বলতে হচ্ছে। কিন্তু আমরা একে নদ বলি। নদ এবং নদীর মধ্যকার লিঙ্গ বিভাজন সম্ভবত পৃথিবীর এই অঞ্চল ব্যতীত অন্য কোথাও নেই। আর এই বিভাজনের কারণ শাখায় নয়, ব্যাকরণে। পুরুষবাচক নামের ক্ষেত্রের জলধারাকে আমরা নদ হিসেবে ডাকছি। আর নারীবাচক নামের জলধারাকে নদী। সেজন্য ব্রহ্মপুত্র, কপোতাক্ষ হলো নদ, কিন্তু পদ্মা, মেঘনা যমুনা হচ্ছে নদী। তবে এর ব্যতিক্রম রয়েছে। যেমন, আড়িয়াল খাঁ একটি পুরুষবাচক শব্দ হলেও এটি একটি নদীর নাম।
ব্রহ্মপুত্রের সর্বনাশ
মরা ব্রহ্মপুত্র নদে আজ আমার অস্তিত্ব শুয়ে
যেন এক চিতলের শঙ্খশাদা হাড়
– (পহেলা বৈশাখ, সৈয়দ শামসুল হক)
এককালের প্রাণবন্ত, খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্র নদ আজ মৃতপ্রায়। বিশেষ করে, বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার, জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ অঞ্চলে দখলদারি এবং বর্জ্য নিষ্কাশনের কারণে প্রশস্ত নদ আজ মৃতপ্রায় খালের ন্যায় টিকে আছে। এর ফলে নদ হারিয়েছে নাব্যতা, হুমকির মুখে আছে নদের উপর নির্ভরশীল প্রাণিসম্পদ। কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য ফেলার কারণে আড়াইহাজার অঞ্চলে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। বর্ষা মৌসুমে নদের পানি বাড়লেও শুষ্ক মৌসুমে ধু-ধু বালুচরে ছেয়ে যায় নদের দুই পাড়। বিশেষজ্ঞ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে ভাটির দিকে পলি জমে নদের বড় অংশ ভরাট হয়ে গেছে। এর ফলে ব্রহ্মপুত্রের সাথে যমুনার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অতি দ্রুত এখানে খনন না করলে পরবর্তীতে নদকে বাঁচানো যাবে না। তবে শুধু নদ খনন করলেই সমাধান হবে না। ইতোমধ্যে দূষিত পানি থেকে ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। আধুনিক নকশা প্রণয়ন করে এসব শিল্প-কারখানায় উন্নতমানের নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করার বিকল্প নেই। ব্রহ্মপুত্রের সর্বনাশ মানে বাংলাদেশের সর্বনাশ। এই নদ ধ্বংস হলে আমাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অবস্থা এবং পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে।
Add comment