বেলাই বিল গাজীপুরের কানাইয়া তে অবস্থিত একটি ভ্রমণস্থান। বেলাই বিলে এক বেলা প্রকৃতির কোলে নৌকায় ঘুরে কাটাতে পারেন সকল বিষন্নতা ভুলে। গাজীপুর জেলার পরিচিতি শুধুমাত্র ছোট টিলা, বনভূমিতে সীমাবদ্ধ নয়, উঁচু এলাকার পাশাপাশি এখানে বেশ কিছু বিলও আছে। বর্ষার সময় গাজীপুরের বিলগুলোর সৌন্দর্য বেড়ে যায় কয়েকগুন। গাজীপুর সদরের জয়দেবপুর থানা থেকে বালু ও চিলাই নদীর সংস্পর্শে বেলাই বিল গাজীপুরের বিল গুলোর মধ্যে অন্যতম।
গাজীপুরের বেলাই বিল
বেলাই বিল বা কানাইয়া ব্রিজ বা কানাইয়া বাজার বা সংক্ষেপে কানাইয়া বলতে একটি স্থান কেই বোঝানো হয়, যা আজকের লেখার মূল আকর্ষণ। বেলাই বিলের রূপকথার মত গল্পে জানা যায়, ভাওয়ালের অধিপতি প্রায় ৮০ টির মত খাল খনন করে, যা পরবর্তীতে চিলাই নদীর সাথে সংযুক্ত হয়ে প্রকান্ড বিলে পরিনত হয়। এই প্রকান্ড বিলটিই আমাদের আজকের বেলাই বিল। গাজীপুর জেলার ৮ বর্গমাইল এলাকা বিস্তৃত এই বিলটি ঘিরে রয়েছে বাড়িয়া, ব্রাহ্মণগাঁও, বক্তারপুর ও বামচিনি মৌজা গ্রাম। শুকনো মৌসুমে বিলটির বেশিরভাগ এলাকা ব্যবহৃত হয় ফসলি জমি হিসেবে, যাতে বোরো ধানের চাষ হয়ে থাকে। বর্ষার মৌসুমে খরস্রোতা চিলাই নদীর মত বিলটিও হয়ে ওঠে টইটম্বুর যা এর সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুন ৷ বিলের আশেপাশে জেলেরা ডাঙ্গি খনন করে মাছ ধরার উদ্দেশ্যে। এই তাজা মাছ কেনার উদ্দেশ্যে অনেকেই ভীড় জমায় কানাইয়া বাজারে ৷ তবে শুধুমাত্র কানাইয়া বাজার না, এই বিলের মাছের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে জয়দেবপুর ও এর আশেপাশের বাজার গুলোতে।
বেলাই বিল এর মোহনীয়তা
বিস্তৃত এই বিল এলাকাটির সৌন্দর্য দুই মৌসুমে দুইরকম ভাবে প্রকাশ পায়। শুকনো মৌসুমে বেলাই বিল বা কানাইয়া ব্রিজে গেলে দেখা যায় অবারিত ধানক্ষেত, যার মাঝ বরাবর চলে গেছে ছায়ায় ঘেরা মাটির রাস্তা। আর দমকা হাওয়াতে ঘুরে বেড়ায় মিষ্টি ধানের ঘ্রাণ। কৃষকদের ধান কাটার দৃশ্য আর গ্রামীণ পরিবেশ যে কারও মনকে হালকা করে তুলবে। আপনি বাস্তবিক অর্থেই বুঝতে পারবেন জাতীয় সংগীতের মর্মার্থ- “ও মা, অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি”
তবে বর্ষা ছাড়া অন্য সময়ে গেলে বর্ষার টইটম্বুর রূপ দেখা যায় না ৷ বেলাই বিলের আসল সৌন্দর্য ফুটে উঠে বর্ষায়। যারা নিরিবিলি নৌকায় এক বিকেল ঘুরে বেড়াতে চান, আর উপভোগ করতে চান স্নিগ্ধ শান্ত হাওয়া, তাদের জন্য বর্ষা মৌসুমে বেলাই বিল মূল আকর্ষণ হতে পারে। জুন-সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বেলাই বিল থাকে কানায় কানায় পূর্ণ ৷ এসময় শুকনো মৌসুমের সেই মাটির পথটাও অনেকটা পানির নিচে চলে যায়। পুরো এলাকাটি ভরে উঠে বর্ষার টলমলে পরিষ্কার ধারায় । এই পানিতেই গাছগুলো মাথা জাগিয়ে থাকে আর এর মাঝেই নৌকাগুলো আমাদের নিয়ে ভেসে বেড়াবে আমাদের যেদিকে মনে চায়। মাঝিকে জোরে নৌকা টেনে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে, ফেরার পথে ধীরে ধীরে নৌকা বাইতে বলতে পারেন। এতে বিলের বিস্তৃত রূপ বেশি সময় উপভোগ করার সুযোগ পাবেন। কিছুটা ভেসে বেড়ালেই চোখে পরবে শাপলার দল, হাত বাড়িয়ে তাদের ছুয়ে দিয়েই সামনে এগিয়ে যাবে নৌকা। পা ভিজিয়ে আনমনে রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে উঠতে পারেন বৈঠার তালে তালে। দিগন্তে বেলা ফুরাবার হাতছানি নিয়ে নৌকা ফিরে আসবে ঘাটে।

বেলাই বিলের যাত্রাপথ
বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে ঢাকা থেকে সহজেই গাজীপুর পরিবহনে উঠে জয়দেবপুর শিববাড়ি মোড়ে নেমে অটো বা রিকশায় সরাসরি চলে যেতে পারেন কানাইয়া ব্রিজ, এক্ষেত্রে অটোতে ভাড়া পরবে জনপ্রতি ৩০-৩৫ টাকা। বা ২০টাকা ভাড়া দিয়ে রিকশা নিয়ে রেলগেট গিয়ে পুনরায় কানাইয়া বাজারের নির্ধারিত অটোতে উঠতে পারেন।
এছাড়া ট্রেনে এসে জয়দেবপুর রেলস্টেশনে নেমে স্টেশন থেকে বের হয়ে রেলগেট থেকে কানাইয়া বাজারের জন্য নির্ধারিত অটোতে উঠে যেতে পারেন কানাইয়া বাজার, অটোতে ভাড়া নিবে জনপ্রতি ১৫ টাকা। পথে উপভোগ করতে পারবেন গাজীপুরের ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘর, গ্রামীণ পরিবেশ।
কানাইয়া বাজারে অটো থেকে নেমে বাজারের রাস্তা ধরে খানিকটা হাটলেই কানাইয়া ব্রিজ যার সংলগ্ন পথের সাথেই আমাদের কাঙ্ক্ষিত নৌকার ঘাট। নৌকায় উঠার আগে কানাইয়া বাজার থেকে নিয়ে নিতে পারেন হালকা কিছু নাস্তা।
ঘাটে ইঞ্জিনচালিত ও বৈঠা দুইরকম নৌকাই আছে। নিরিবিলি শান্ত পরিবেশে ঘুরতে চাইলে বৈঠা চালিত নৌকায় উঠাই শ্রেয়। ঘন্টাপ্রতি হিসেবে মাঝিরা নৌকায় ঘুরিয়ে থাকে, এক ঘন্টায় ৩০০-৩৫০ টাকা দাবি করে থাকে তারা, এক্ষেত্রে অবশ্যই দরদাম করে নৌকায় উঠবেন। সাধারণত ঘন্টাপ্রতি ২৫০-৩০০ টাকাতেই তারা রাজি হয়।
দিনভর পিকনিকের জন্য অনেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা “কুশা” ভাড়া করে থাকে।
বেলাই বিলের হাতছানি
বেলাই বিলের ঘুরার উপযুক্ত সময় বিকাল ৪-৬টা পর্যন্ত। এসময় বিকালের রোদ পরে আসে আর মৃদুমন্দ বাতাসে বিলের পরিবেশ মোহনীয় হয়ে উঠে। তাই চেষ্টা করবেন আপনার ঘুরতে যাওয়ার সময়টা যেন দুপুর গড়ায়। সন্ধ্যা বা শেষ বিকেলে গেলে আপনাকে হতাশ হতে হবে।
নামেই যার বিল আছে তার অপূর্বতা দেখার জন্য জুন-সেপ্টেম্বর মাসে ঘুরতে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। তবে যেকোন উৎসব, ঈদ, পূজা পার্বণে বেলাই বিলে ভীর থাকে অন্যান্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। আর মাঝিরাও নৌকার ভাড়া কমাতে চায় না, চেয়ে বসে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি টাকা। তাই পরামর্শ থাকবে যেকোন উৎসবের দিন বাদ দিয়ে যাওয়ার, তাহলে বেলাই বিলের প্রকৃত শান্ত রূপ উপভোগ করতে পারবেন।
থাকা খাওয়া
কানাইয়া বাজার এলাকায় তেমন কোন থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। একবেলা ঘুরার জন্য যানজট হিসাব করে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে দুপুরে এসে শিববাড়ি মোড় নামতে পারেন। এখান থেকে রিকশায় কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলেই খাবার হোটেল চোখে পরবে, এরমধ্যে সুরমা হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে রেলগেট থেকে অটোতে রওনা দিতে পারেন কানাইয়া বাজারের উদ্দেশ্যে।
সন্ধ্যার মধ্যে বেলাই বিল ঘুরে কানাইয়া বাজারে ফিরে এসে অটোতে করে শিববাড়ি এসে পুনরায় গাজীপুর পরিবহনে চলে যেতে পারেন ঢাকায়। তবে যানজটের কথা চিন্তা করে অটো থেকে রেলস্টেশনে নেমে ধরতে পারেন ঢাকার কোন ট্রেন।
গাজীপুরের স্থানীয়রা কানাইয়া বাজার থেকে ফেরার পথে নিয়ে নিতে পারেন তাজা শাকসবজি আর বিলের মাছ। বাড়ি ফিরলে হয়ত মায়ের মিষ্টি শাসনের সাথে ভালবাসাও পাবেন এগুলোর মতই একদম টাটকা।
সবুজ আচ্ছাদিত গাজীপুর জেলার রূপ সৌন্দর্য সকল ঋতুতেই আপনার নজর কারবে। আর বেলাই বিল বর্ষার মৌসুমে বিনোদনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে বিগত কয়েক বছরে। শহরের কোলাহল থেকে দূরে শান্ত নিবিড় গ্রামঘেড়া বেলাই বিলে নৌকা নিয়ে ঘুরতে পারেন নিজের প্রশান্তির জন্য৷ আমন্ত্রণ থাকবে গাজীপুরের বেলাই বিলে একবেলা ঘুরে যাওয়ার।
কন্টেন্ট রাইটার – সুমাইয়া নাসরিন তামান্না
Add comment