Porjotonlipi

বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ ও রাঙামাটি কাপ্তাই লেক

বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি অন্যতম নাম, যিনি চির নিদ্রায় শায়িত আছেন রাঙামাটির কাপ্তাই লেকের বুকে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি রাঙ্গামাটি। এখানে পাহাড় আর জলের যেন এক গভীর মিতালী। দুচোখ ভরে দেখলেও রূপের রাণীর অপরূপ সৌন্দর্য যেন শেষ হয়না। এ যেন এক চোখ ধাঁধানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আঁধার।

বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ এর স্মৃতিবিজড়িত রাঙ্গামাটি

চারদিকে কাপ্তাই লেকের অথৈ নীল জলরাশি বয়ে চলেছে কলকল শব্দে। এই জলরাশির মাঝেই জেগে আছে ছোট্ট একটি দ্বীপ। নাম তার রউফ টিলা। নামটা প্রথমবার শুনে যেকোন পর্যটকের মনই কিছুটা অনুসন্ধিৎসু হয়ে উঠবে। একটা দ্বীপের এ আবার কেমন নাম? কিন্তু নাম শুনে কেউ কখনো ভাবতেও পারবেনা যে, এই রউফের টিলা নামক জায়গাটির সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের কি বিশাল এক বীরত্ব গাঁথা জড়িয়ে আছে। এখানেইযে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন মুক্তিযুদ্ধের একজন বীর সেনানী। বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধি অবস্থিত এই দ্বীপে।

এক মরণপণ যুদ্ধ দিনের পূর্বকথা

১০ এপ্রিল চট্টগ্রামের কালুরঘাট ব্রিজ পাকিস্তানিদের দখলে চলে গেলে মেজর মীর শওকত আলী তার সৈন্যদের নিয়ে পটিয়া ও কাপ্তাই হয়ে এপ্রিলের মধ্যবর্তী সময়ে রাঙামাটি এসে পৌঁছান। সার্বিক বিবেচনায় তিনদিক পাহাড়-জঙ্গল পরিবেষ্টিত মহালছড়ি অধিকতর নিরাপদ মনে হওয়ায় তিনি তার অস্থায়ী সদর দপ্তর রাঙামাটির পরিবর্তে এখানে স্থাপন করেন। মহালছড়ি থেকে সীমান্তবর্তী রামগড়ের দূরত্বও খুব বেশি নয়। সেখানে মেজর জিয়া তার সেনাসদস্যদের নিয়ে অবস্থান নিয়েছিলেন। রামগড় ক্যাম্প থেকে আর্টিলারি অফিসার ক্যাপ্টেন কাদের মহালছড়িতে মেজর মীর শওকতের বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেন। পাকিস্তানি বাহিনী যাতে তার হেডকোয়ার্টারের দিকে অগ্রসর হতে না পারে, সেজন্য মেজর শওকত এর আশপাশে একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যুহ তৈরি করেন। সে অনুযায়ী ক্যাপ্টেন কাদেরের নেতৃত্বে ১০০ জনের একটি সেনাদল বুড়িঘাটের নিকটবর্তী ঘাগড়ায়, সুবেদার মোতালেবের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ কুতুবছড়ি এলাকায় এবং লে. খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে ১০০ সদস্যের অপর একটি দলকে বুড়িঘাটে মোতায়েন করা হয়। মুন্সী আব্দুর রউফ এ দলের সদস্য ছিলেন। বাকি ৭০ জনের মতো সেনাসদস্যকে লে. মাহফুজের অধীনস্থ করে মহালছড়ির হেড কোয়ার্টার্সের নিকটস্থ চেঙ্গীখালের উভয় পাড়ে অতিরিক্ত ফোর্স হিসেবে প্রস্তুত রাখা হয়।

সংক্ষেপে সেদিনের যুদ্ধের কিছু স্মৃতিচারণ

২০ এপ্রিল পার্বত্য চট্টগ্রামে রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি জলপথ প্রতিরোধ করার জন্য ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কোম্পানী সৈন্যের সাথে বুড়িঘাটে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় শত্রুপক্ষের কমান্ডো ব্যাটালিয়নের একটি কোম্পানি ৬টি ৩ ইঞ্চি মর্টার নিয়ে ৩টি লঞ্চ ও ২টি স্পিডবোটে করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা এলাকার মধ্যে ঢুকে পড়ে। মুক্তিবাহিনীকে দেখামাত্র মর্টার ও অন্যান্য অস্ত্র দিয়ে তারা গোলাবর্ষণ শুরু করে। শুরু হয় উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ। মুন্সী আব্দুর রউফ নিজের মেশিনগান দিয়ে শত্রুর ওপর গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। একদিকে হানাদারদের ভারী অস্ত্র, অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সীমিত অস্ত্র ও অস্ত্রের গুলি ফুরিয়ে আসায় এক পর্যায়ে লে. খালেকুজ্জামান মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ প্রত্যাহার করে পশ্চাদপসরণের নির্দেশ দেন।

বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ এর দুঃসাহসিকতা

নির্দেশ অনুযায়ী অন্য সবাই দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরে গেলেও মুন্সী আব্দুর রউফ হালকা মেশিনগান হাতে অসীম সাহসের সাথে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের পশ্চাদপসরণ সহজ ও নিরাপদ হয়। তারা কেউ সাঁতরে পাশের ঝোঁপে, কেউবা গাছ বা পাহাড়ের আড়ালে আশ্রয় নেন। মুন্সী আব্দুর রউফ একাই চালাতে থাকেন মেশিন গান। তুমুল যুদ্ধের এক পর্যায়ে হঠাৎ শত্রুদের মর্টারের গোলা এসে মুন্সী আব্দুর রউফের শরীরে আঘাত হানে। মুহূর্তে তার দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। শহীদ হন দেশমাতৃকার অকুতোভয় সন্তান মুন্সী আব্দুর রউফ।

সরকারি স্বীকৃতি

বাংলাদেশ সরকার মুন্সী আব্দুর রউফকে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন ও আত্মদানের জন্য সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাব প্রদান করে এবং বাংলাদেশ রাইফেলস ১৯৭৩ সালে সিপাহী মুন্সী আবদুর রউফকে অনরারি ল্যান্স নায়েক পদে মরনোত্তর পদোন্নতি প্রদান করে।

সেদিনের এক প্রত্যক্ষদর্শী

একটি আম গাছের উঁচু ডালে বসে দয়াল কৃষ্ণ চাকমা নামে স্থানীয় একজন লোক শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সেদিনের পুরো যুদ্ধটি দেখেছিলেন। পরের দিন সকালে তিনি যে টিলায় মুন্সী আব্দুর রউফ যুদ্ধ করছিলেন, সেখানে যান। গিয়ে দেখেন একজন সৈনিকের দেহ ছিন্ন-ভিন্ন অবস্থায় পড়ে আছে। পাশে একটি এলএমজি ও গুলির খোসা। তিনি দেহাংশগুলো কুঁড়িয়ে এনে গর্ত করে কবরস্থ করেন আর একটি খুঁটি দিয়ে স্থানটি চিহ্নিত করে রাখেন। ওই পথ দিয়ে যাওয়া-আসার সময় প্রায়ই তিনি সেখানে গিয়ে কবরটি দেখে আসতেন।

ছবিঃ সংগৃহীত

বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ এর সমাধির খোঁজ ও আধুনিকায়ন

এরপর কেটে যায় ২৬টি বছর। ১৯৯৬ সালে সরকার মুন্সী আব্দুর রউফসহ বাংলাদেশের ভেতরে ও ভারতের মাটিতে যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কবর অচিহ্নিত অবস্থায় রয়েছে, সরেজমিনে সেসব কবর সন্ধানের উদ্যোগ নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় সে সময় বুড়িঘাট যুদ্ধের অন্যতম যোদ্ধা, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা রবার্ট রোনাল্ড পিন্টুর মাধ্যমে প্রথমে খোঁজ মিলে দয়াল কৃষ্ণ চাকমার। তার সহায়তায় চিহ্নিত হয় মুন্সী আব্দুর রউফের কবর। এরপর রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের উদ্যোগে কবরটি পাকা করা হয়।

কিভাবে যাবেন

নানিয়ারচরে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধিস্থলে যেতে রাঙামাটির যে কোনো স্থান থেকে নৌপথে এক ঘণ্টা সময় লাগে। তবে রাঙ্গামাটি ফিসারিঘাট থেকেও নৌপথে খুব সহজেই যাওয়া যায় এ রউফ টিলায়। আর কাপ্তাই লেকে সেনাবাহিনীর টহল টিম নিরাপত্তা নিশ্চিত করায় নির্ভয়ে এ সমাধিসৌধে সম্মান জানাতে যেতে পারেন আপনিও। সেই সাথে অনুভব করে আসতে পারেন দেশের জন্য অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দেয়া এক অকুতোভয়, দুঃসাহসী বাঙ্গালী বীরের মৃত্যুকে জয় করে অমর হয়ে থাকার বীরগাঁথা।

 

ফাহিম সাদেক সৌরভ

Add comment