প্রায় ৫ মাস যাবৎ হাঁসফাঁশ করছিলাম বাসায় বসে, শান্তি পাচ্ছিলাম না ঠিকমতো। বিগত তিন বছরে এমন কখনো হয়নি। প্রতিমাসে কোথাও না কোথাও বের হওয়া হতো। কিন্তু এই বছরটা যে এভাবে সব ভেস্তে দিবে সেটা ভাবতে পারিনি। অনেক প্ল্যান ছিলো এই বর্ষাকে ঘিরে কিন্তু কিছুতেই কোন প্ল্যান এক্সিকিউট করতে পারছিলাম না। অবশেষে, বর্ষার একেবার শেষ সময়ের দিকে হলেও একখন্ড শান্তি পাবার আশায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে বের হয়ে যাই বাসা থেকে। হুক্কাহুয়া ডাকার আগেই দেখি আশেপাশের ১৫ জন রেডি হয়ে বসে আছে। ব্যাস সবাইকে নিয়ে বের হয়ে পড়লাম কাপ্তাই অভিযানে।
বিলাইছড়ির ধূপপানি ঝর্ণা
এবারের অভিযান বিলাইছড়ির ধূপপানি ঝর্ণা। পুরোটা ট্যুরের ১০-১২ ঘন্টা নৌকার উপর, শুয়ে, বসে, তাশ খেলে, খেয়ে কাটাতে হয়েছে। নৌকাতে বসতে বসতে ইঞ্জিনের শব্দে মনে হচ্ছিলো কানে তালা লেগে গেছে। কিন্তু নৌকার উপর শুয়ে, বসে পুরো পার্বত্য রাঙ্গামাটির যে অপার্থিব দৃশ্য দেখলাম তা এক কথায় প্রাইসলেস। কোনো ক্যামেরাই কাপ্তাই এর আসল সৌন্দর্য্য তুলে ধরতে পারবে না। এই কারণেই মুরব্বীরা বলেন, চোখের লেন্সের উপর আর কোনো বড় লেন্স হতে পারে না। চোখের ক্ষিধে মিটিয়ে বের হয়ে পরি ঝর্না অভিযানে। জীবনে এই প্রথম কোনো ঝর্না দেখতে গিয়ে একটু হতাশ হতে হলো, এক্সপেকটেশনের তুলনায় এবার পানি অনেক কম পাইছি। তাতে কি, পুরো ট্যুরে যেমনটা চেয়েছি তার চেয়ে অধিক ভালোবাসা, আপ্যায়ন, খাতির পেয়েছি। পুরো ট্রলার জার্নিতে কখনো মেঘ, কখনো রোদ, কখনো রংধনু, কখনো পাহাড়ের ভাজে ভাজে মেঘ রোদ্দুরের খেলা সবকিছুই বিমোহিত করেছে আমাদের।
ধূপপানি ঝর্ণার কিছু কথা
বিলাইছড়ির ধূপপানি ঝর্ণা এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর ঝর্ণাগুলোর মধ্যে একটি। সুবিশাল উচ্চতা, শুভ্র জলরাশির ঝর্ণা আর ঝর্ণার নিচের গুহার জন্য ট্রেকারদের কাছে এই ঝর্নাটির আবেদন সবসময় অন্যরকম। ঝর্ণার স্বচ্ছ পানি এবং অনেক উচুঁ থেকে আছড়ে পড়া জলরাশি আপনাকে একরকম পাগল করে দিবে, ধূপপানি ঝর্ণার নিচের গুহায় চোখ বন্ধ করে বসলে মনে হবে অন্য কোন জগতে চলে গেছেন।
১ম দিন ও ১ম রাত:
কাপ্তাই নেমে হালকা নাস্তা করে কাপ্তাই ঘাট থেকে ট্রলারে ২ ঘন্টায় বিলাইছড়ি (পথে আর্মি চেক পোস্ট পড়বে, আই ডি কার্ড এর ফটোকপি জমা দিয়ে পারমিশন নিতে হবে), সেখানে আগে থেকে ঠিক করা রেস্ট হাইজে আমরা চলে যাই এবং ফ্রেশ হয়ে গাইড নিয়ে ন-কাটা ঝর্ণা এবং মুপ্পোছড়া ঝর্ণার উদ্দ্যেশে যাত্রা করি, ১ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গিয়েছিলাম ন-কাটা ঝর্ণায়, এখানে কিছু সময় কাটিয়ে ৩০-৩৫ মিনিট ট্র্যাকিং করে পৌঁছে গেলাম মুপ্পোছড়া ঝর্ণায়।
২য় দিন ও ২য় রাত :
খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে ট্রলারে করে প্রায় ২ ঘন্টায় উলুছড়ি পৌঁছে যাবেন, রাতে খাওয়ার সময় সকালের নাস্তার অর্ডার দিয়ে রাখবেন, নাস্তা ট্রলারএ করে নিবেন। পথে ২টা আর্মি চেকপোস্ট পড়বে (আগে থেকে সবার আই ডি কার্ড এর কপি একজায়গায় গুছিয়ে রাখবেন) । আপনার ট্রেকিং জানা থাকলে ১:৪৫-২ ঘন্টার মতো সময় লাগবে কাঙ্খিত ধূপপানি ঝর্ণায় পৌঁছতে। ঝর্ণার কাছে আসার পর আমার অনুভূতি কোনো ভাবেই ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না, যাদের সম্ভব আমি বলবো একবার হলেও এই বর্ষায় ঘুরে আসুন ….আপনার হাজার বছর মনে থাকবে….ট্রলার রিজার্ভ করা থাকলে দুপুর ২টার মধ্যে ধূপপানির মায়া ত্যাগ করে আপনাকে ফিরে আসতে হবে, বিলাইছড়ি পৌছে দুপুরের লাঞ্চ করে আপনাকে ফিরে আসতে হবে কাপ্তাই, বোনাস হিসেবে দেখবেন নীলাভ কাপ্তাই লেক, আর সূর্য অস্ত যাওয়ার দৃশ্য দেখে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলে আপনি সাধারণ কেউ নন ….. কি আর করার নিজেকে অসাধারণ প্রমান করে কাপ্তাই চলে আসলাম ❤️
**সতর্কতা:
১) আপনাকে অবশ্যই সময়ের সাথে চলতে হবে। কারন এখানকার লোকাল বোট এবং রাঙ্গামাটি থেকে ফিরতি বাস (যারা ঢাকায় যাবেন, সময় রাত ৮:৩০) Sharp time এ চলে।
২) এখানে Teletalk আর Robi ছাড়া অন্য কোন সিমের নেটওয়ার্ক থাকে না।
৩) ধুপপানি হচ্ছে এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর তীর্থ স্থান। তাই এখানে এসে চিল্লাপাল্লা ও উচ্চবাচ্য করবেন না।
**যা সাথে থাকতেই হবে:
১) ভোটার আইডি কার্ড (1st priority)
(অন্যথায় কলেজ/ভার্সিটি আই,ডি,কার্ড বা জন্মসনদ/পাসপোর্ট এর ফটোকপি)
২) যথেষ্ট পরিমান পলিথিন
৩) ট্রেক করার উপযোগী জুতা/সেন্ডেল

**বাজেট
সিলেট টু চট্টগ্রাম (ট্রেনে ৩৭৫*২)= ৭৫০ আসা যাওয়া
চট্টগ্রাম থেকে বাসে ২০টাকা।
বহদ্দারহাট টু কাপ্তাই বাস ভাড়া ৮০টাকা। সকালের প্রথম ট্রিপের গাড়ী ছিলো সকাল ৭.৪০ এ।
কাপ্তাই থেকে বিলাইছড়ি বোট (১০০*২)= ২০০ টাকা
রাতের খাবার + পরদিন সকালের নাস্তা (১২০+৭৫)= ১৯৫ টাকা
** প্রথম দিন দুইটা ঝর্ণা (ন-কাটা এবং মুপ্পোছড়া ঝর্ণা) পরেরদিন ধুপপানি এর জন্য নৌকা ভাড়া ৩০০০টাকা। ১৫ জনের গ্রুপ ছিলো।
মুপ্পোছড়া ও ন-কাটার জন্য গাইড খরচ ৫০০
ধুপপানির জন্য ৫০০
মুপ্পোছড়া ঘাটে নৌকা পার্কিং খরচ ১০০
ব্রিঃ দ্রঃ বিলাইছড়ির ধূপপানি ঝর্ণা অভিযানে আমরা অনেক হেল্প পেয়েছিলাম! বিলাইছড়ির ইউএনও আমাদের ক্যাম্পাসের বড় ভাই থাকাতে আমরা নীলাদ্রী কটেজে ফ্রী ছিলাম৷ সকালের নাস্তা ট্রিট ছিল! রাঙ্গামাটি থেকে ব্যাক করার সময় ওখানকার ম্যাজিস্ট্রেট ডিপার্টমেন্টের ভাই চিটাগাং পৌঁছানোর ১৫টা টিকেট করে দেন।। তাই সঙ্গত কারনে পুরো খরচ কতো হলো তা লিখলাম না। আপনারা যারা চিটাগাং থেকে যাবেন তাদের ১৯০০ আর ঢাকা থেকে গেলে ২৮০০ মধ্যে পুরো ট্যুর কম্পলিট হয়ে যাবে।
**মাঝির মোবাইল নং:
01539530037 (ইউসুফ মামা)
নৌকা বেশ বড় এবং মাঝি অত্যন্ত আন্তরিক ছিল। উলুছড়ি থেকে নেয়া গাইড ছিল বিজয় চাকমা।
[বি.দ্র. আমরা যেদিন ঝর্ণা দেখতে যাই, তার আগের ২/৩ দিন তেমন বৃষ্টি হয় নি, তবে আমাদের ট্রেকিং থেকে ফিরার পথে ১০মিনিটের বৃষ্টি নামায় রাস্তা পিচ্ছল এবং কর্দমাক্ত হয় যায় শীতকালে গেলে বৃষ্টির প্রকোপ থেকে রক্ষা পাবেন। কিন্তু সুন্দর ভিউ মিস করবেন!
সবাইকে বিনীতভাবে অনুরোধ করা গেলো ময়লা যেখানে সেখানে ফেলবেন না, কাপ্তাই লেকের সুন্দর পরিবেশ নষ্ট করবেন না। বিলাইছড়ি এমনিতেই খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জায়গা। সকালের নাস্তা নৌকাতে করে খাবারের প্যাকেট, খাবারের উচ্ছিষ্ট অংশ পানিতে ফেলবেন না দয়া করে। একটা ব্যাগে জমিয়ে তারপর নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলুন। ধন্যবাদ সকলকে।
কন্টেন্ট রাইটার ও ফটোগ্রাফারঃ কাওসার আহমেদ কাইফ
Add comment