Porjotonlipi

বিউটি লাচ্ছি – ফালুদা : পুরান ঢাকার বিউটি

বিউটি লাচ্ছি গত ১৫ই জুন, ২০২১ এ শততম বর্ষে পা রেখেছে এবং আগামী বছর তার শতবর্ষ পূর্ণ করবে। তাই চলুন পুরান ঢাকার প্রায় শতবর্ষী এবং অনন্ত যৌবনার সুপরিচিত এই প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস থেকে একবার ঘুরে আসা যাক।

ঐতিহ্যবাহী বিউটি লাচ্ছি – ফালুদা 

বর্তমান সময়ে যেখানে প্রতিদিন নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন হচ্ছে এবং প্রতিযোগিতা কঠোর থেকে কঠোরতর হচ্ছে, সেখানে সময়ের সাথে পাল্লা দিতে যেয়ে অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানই টিকতে পারে না সেখানে রেঁস্তোরাগুলির তাদের আয়ুষ্কাল পূর্ণ করা তো অসম্ভব কে সম্ভব করার সমান। অনেক রেঁস্তোরাই সৃজনশীলতার মাধ্যমে প্রথমে মানুষের মনে একটি উন্মাদনা তৈরী করে, কিছু বছর দারুণ ব্যাবসা করে এবং পরিশেষে সময়ের পরিক্রমায় হারিয়েও যায়।

কিন্তু যারা সময়ের এই বিধ্বংসী স্রোতের বিপরীতে টিকে থাকে তারাই ইতিহাসের পাতায় নিজেদের পরিচয় খোদাই করে দেয়। তেমনই একটি রেঁস্তোরা হচ্ছে “বিউটি লাচ্ছি” – ১০০ বছর আগে একজন খুবই সাধারণ মানুষের কষ্ট এবং ঘামের বিনিময়ে যেটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

বিউটি লাচ্ছি এবং ফালুদা ১৯২২ সালে মরহুম আব্দুল আজিজের হাতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তিনি একজন নির্মাণ শ্রমিক ছিলেন যিনি নির্মাণশৈলীর পাশাপাশি রায় সাহেব বাজারের রাস্তায় “লেবুপানি” এবং “লাচ্ছি” বিক্রি করতেন। সেই ১০০ বছর আগে তার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না তার হাতের তৈরী এই অনন্য সৃষ্টিগুলি মানুষকে আজও তৃপ্তি দিয়ে যাবে।

শতাব্দীর ঐতিহ্য এবং আজকের বিউটি লাচ্ছি 

পুরান ঢাকার প্রাণকেন্দ্র ৩০/১, জনসন রোড, ঢাকায় বিউটি লাচ্ছির প্রধান এবং প্রথম শাখা অবস্থিত। বিউটি লাচ্ছি শপের বাইরে পিপাসার্ত এবং অপেক্ষারত লোকের জমায়েত হওয়া রোজকার ঘটনা। বিউটি লাচ্ছির সামনে গেলে এই ভীর ঠেলে ভেতরে গেলেই দেখা মিলবে বিউটি লাচ্ছির অন্যতম অধিকারী জনাব মো. জাবেদ হোসেনের। মরহুম আব্দুল আজিজের নাতি তিনি। পাকিস্তান আমলে মরহুম আব্দুল আজিজ এই দোকান ভাড়ায় নেন। তৎকালীন সময়ে সেখানে কোন কংক্রিটের তৈরী দালান ছিল না। জনাব আব্দুল আজিজের মৃত্যুর পরে তার ছেলে মরহুম আব্দুল গাফফার ব্যবসার হাল ধরেন। আর তার চলে যাওয়ার পরে তার ছেলেরা ব্যবসার দেখভালের দায়িত্ব নেন এবং এর প্রসার ঘটান।

প্রথম দিকে, বিউটি লাচ্ছিতে শুধু লেবুর শরবত বিক্রি হত। ১৯৮০ সালের থেকে বিউটি লাচ্ছির সুনাম বাড়তে থাকে এবং ধীরে ধীরে পুরান ঢাকা সহ সকল স্তরের খাদ্যপ্রেমী মানুষের ভালবাসা এবং আস্থা অর্জন করে নেয়।

২০০০ সালের দিকে, সময়ের প্রয়োজনে এবং ব্যবসায় ভিন্নতা আনতে তারা তাদের খাদ্যতালিকায় “স্পেশাল ফালুদা” যোগ করে। তারা বর্তমানে লেবুর শরবত (চিনি এবং চিনি ছাড়া উভয়ই), লাচ্ছি, স্পেশাল লাচ্ছি, ফালুদা এবং স্পেশাল ফালুদা পরিবেশন করে থাকে।

এক গ্লাস লেবুর শরবতের দাম পড়বে ২০টাকা এবং স্পেশাল লাচ্ছির দাম ৪০টাকা প্রতি গ্লাস। এক কাপ স্পেশাল ফালুদার জন্য আপনাকে ৮০টাকা গুনতে হবে।

পুরান ঢাকার মানুষের মনে বিউটি লাচ্ছি একদম আপন জায়গা করে নিয়েছে। সেখানের মানুষেরা এটাকে শুধু “বিউটি” নামে সম্বোধন করে। পুরান ঢাকার মানুষের কাছে বিকালের হালকা নাস্তা কিংবা প্রখর রোদের থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য প্রথম পছন্দ বিউটির লাচ্ছি।

বিউটি লাচ্ছি তিনপুরুষ ধরে চলে আসছে। মরহুম আব্দুল আজিজ এটি প্রতিষ্ঠা করেন। তার মৃত্যুর পরে তার ছেলে মরহুম আব্দুল গাফফার ২০০০ সাল পর্যন্ত এটির দেখভাল করেন। তার ইন্তেকালের পরে তার ছেলেরা এখন এটি চালাচ্ছেন। তারা আশা করেন তাদের পরবর্তী প্রজন্মও তাদের পূর্বপুরুষের তৈরী এই ঐতিহ্য ধরে রাখবে।

বিউটি লাচ্ছির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আব্দুল আজিজ
বিউটি লাচ্ছির প্রতিষ্ঠাতা- মরহুম আব্দুল আজিজ ছবি- সংগৃহীত

বিউটি লাচ্ছির সাফল্যের রহস্য:

বিউটির লাচ্ছিতে কি এমন আছে যেটি এই ঐতিহ্যকে ১০০ বছর ধরে বাচিঁয়ে রেখেছে? এই রহস্যের উত্তর লুকিয়ে আছে তাদের লাচ্ছি এবং ফালুদা বানানোর প্রণালীতে। অবাক করার মত হলেও সত্য যে বিউটির কারূশিল্পীরা লাচ্ছি তৈরীতে না কোন ব্লেন্ডার কিংবা কোন আধুনিক মেশিন ব্যবহার করে, না ই বাইরে থেকে লাচ্ছি তৈরীর কাঁচামাল সংগ্রহ করে।

বিউটি লাচ্ছির অনেক পুরাতন এবং অভিজ্ঞ কারূশিল্পী জনাব শহিদুল্লাহর মতে তাদের নিজস্ব মিষ্টান্নভাণ্ডার “মানিক সুইটমিট” থেকে তারা লাচ্ছি এবং ফালুদা তৈরীর জন্য ব্যবহৃত দই নিজেরা তৈরী করে। লাচ্ছি তৈরীর উপাদানগুলি যেমন – দই, চিনির সিরাপ, বরফ ইত্যাদি মিশ্রিত করার জন্য তারা হাত দিয়ে গতানুগতিক “ডাল ঘুটনির” ব্যবহার করে।

কিন্তু এতসব উপাদানের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে বিউটি লাচ্ছির ঐতিহ্য। বাসায় অতিথি আসলে ঘরোয়া তৈরী উপাদেয় যেমন – লাচ্ছি, ফালুদা বা, লেবুর শরবত দিয়ে আপ্যায়ন করা পুরান ঢাকার সংস্কৃতি। গত ১০০ বছর ধরে বিউটি এই সংস্কৃতিকে ভেতরে লালন করে তার ক্রেতাদের সেবা দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে।

জনাব মো. শহিদুল্লাহ নিজেও বিউটির সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের রাজসাক্ষী। মো. শহিদুল্লাহ গত ৩৮ বছর ধরে বিউটি লাচ্ছিতে কর্মরত আছেন। উনি ২০ বছর বয়সে ১৯৮০’র দিকে নোয়াখালী থেকে চাকরির খোঁজে ঢাকায় আসেন। তাকে স্বয়ং বিউটি লাচ্ছির তৎকালীন অধিকারী মরহুম আব্দুল গাফফার নিজে লাচ্ছি বানানোর শিক্ষা দেন। তখন বিউটি লাচ্ছি শুধুমাত্র একটা ছোট্ট টিনশেড দেওয়া একটি ঘর ছিল যেখানে গরমকালে মানুষেরা সন্ধ্যায় লেবুর শরবত বা, লাচ্ছি এবং শীতকালে তাদেরই তৈরী গরুর মাংস এবং চাটনি দিয়ে “আলু পুরি” এবং “ডাল পুরি” খেতে আসত। সময়ের পরিক্রমায় যদিও সেই ছোট্ট টিনশেড দোকান আজ টাইলস লাগানো শপে পরিণত হয়েছে কিন্তু আজও তিনি তার গুরুর দেওয়া দীক্ষা মোতাবেক লাচ্ছি বানান।

পুরান ঢাকায় বিউটি লাচ্ছির বর্তমানে ৩টি শাখা রয়েছে – প্রধান শাখাটি জনসন রোডে, দ্বিতীয়টি নারিন্দায় এবং সর্বশেষ শাখাটি কাজী আলাউদ্দিন রোডে অবস্থিত। আর তাদের মিষ্টান্নভাণ্ডার “মানিক সুইটমিট” ১৯৯৮ সালে মরহুম আব্দুল গাফফার প্রতিষ্ঠা করে যান।

জনসনের রোডের শাখাটি জনাব মো. জাবেদ হোসেন, আলাউদ্দিন রোডের শাখাটি তার ছোট ভাই জনাব মানিক হোসেন এবং নারিন্দা রোডের শাখাটি তাদের বড় ভাই জনাব ইকবাল হোসেন পরিচালনা করেন।

পুরান ঢাকাকে বলা হয় বিরিয়ানির এলাকা। বিরিয়ানির মত এত সুস্বাদু খাবার থাকতেও মানুষ এখনও যেভাবে বিউটি লাচ্ছির প্রতি আসক্ত তাতে বলাই যায় “পুরান ঢাকার বিরিয়ানি আর বিউটির লাচ্ছি না খেলে জীবনটাই বৃথা”! তাই আপনাদের আমন্ত্রণ থাকলো শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকার এই বিউটি লাচ্ছির স্বাদ নেওয়ার জন্য।

 

 

ফারহান মনসুর রহমান

Add comment