Porjotonlipi

ইতিহাসের সাক্ষী বিউটি বোর্ডিং

আজকে আমরা জানবো পুরান ঢাকার একটি অন্যতম আকর্ষণ – বিউটি বোর্ডিং সম্পর্কে। প্রায় শত বছরের পুরনো এই দালানটি এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও এর জৌলুস যেন এখনও সেই আগের মতই। পুরনো এই দালান থেকে ইটপাথর খসে পরলেও বছরের পর বছর অনেক মানুষ এইখানে আড্ডা জমাতে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে চলে আসে খানিকটা একান্ত সময় কাটাতে। 

পুরান ঢাকার বিউটি বোর্ডিং

থাকার পাশাপাশি এখানে অনেকেই আসেন সম্পূর্ণ বাঙালীয়ানা খাবারের স্বাদ পেতে। খুবই কম বাজেটের মধ্যে পরিবার-পরিজন, বন্ধুদের নিয়ে এসে এখানটায় বেড়িয়ে যাওয়া যায়। চলুন তাহলে, কালো কালির লেখায় করে ঘুরে আসি সেই পুরনো বিউটি বোর্ডিং। 

ফিরে যাই শত বছর পূর্বে – ইতিহাসের দেয়ালে 

বিউটি বোর্ডিং শুরুতে ছিল একটি জমিদার বাড়ি, যেখানে থাকতেন জমিদার সুধীর চন্দ্র দাস। পরবর্তীতে, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের আগ পর্যন্ত এটি ছিল সোনার বাংলা  পত্রিকার দপ্তর – যেখান থেকে কবি শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতা উনিশশ ঊনপঞ্চাশ প্রকাশিত হয়। দেশভাগের পরে ১৯৪৯ সালে দুই সহোদর প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা এবং নলিনী মোহন সাহা জায়গাটি ভাড়া নেন এবং গড়ে তোলেন বিউটি বোর্ডিং। নলিনী মোহনের বড় মেয়ে বিউটি’র নামানুসারে বোর্ডিং এর নামা রাখা হয়। তাদেরই বংশোদ্ভূত বর্তমানে বিউটি বোর্ডিং এর দায়িত্ব পরিচালনায় নিয়োজিত আছেন। 

এই পুরান ঢাকাতেই একসময় কবিসাহিত্যিক, চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনেতা – অভিনেত্রীদের, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের বিচরণ ছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের দুর্ঘটনার সাক্ষী এই আবাসিক ভবন। 

বিশ্ব বরেণ্যদের পদচারনায় মুখর যে প্রাঙ্গণ 

এখন যেখানে গেলে শুধুমাত্র দ্বিতল , হলুদ বর্ণের রংচটা, ধ্বংসপ্রায় যে ভবনের দেখা মিলে, এক সময় সেই দালানের দাপট ছিল অন্যরকম। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কর্নেল অলি আহাদের মত রাজনৈতিক ব্যক্তির গর্জে ওঠা এখান থেকেই। পঞ্চাশ দশকের পরে, কবি জসীমউদ্দীন এখানকার নিয়মিত বাসিন্দা ছিলেন। কোন কাজের জন্য তিনি ঢাকা আসলে বোর্ডিং এর প্রথম ঘরটিতে থাকতেন। নির্মলেন্দু গুণ, শহীদ কাদেরি, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শামসুল হকের মত কবিদের আড্ডাখানা ছিল এই হলুদ দালান। বাংলাদেশের প্রখ্যাত জাদুকর জুয়েল আইচ ও একসময়ে তার জীবনের অনেকটা সময় এখানে কাটিয়েছেন। যারা এখানে একসময় নিয়মিত আড্ডা দিতেন, তাঁদের ডাকা হত ‘বিউটিয়ান’। 

ছবি- সংগৃহীত

ঐতিহ্যকে ধরে রেখে বাংলাদেশের টেলিভিশন জগতের অনেক প্রিয়মুখকে এখনও দেখা যায় এখানে। একসময় এখানে আয়োজন করা হত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক মিলনমেলার। 

বাঙালীয়ানা খাবারের এক অভূতপূর্ব স্বাদ মিলবে যেখানে 

পুরান ঢাকা অনেকে ঘুরতে আসেন এখানকার খাবারের স্বাদ নিতে। খাবার খেতে আসেন পুরান ঢাকা, কিন্তু বিউটি বোর্ডিং ঢুঁ মারবেন না, তাহলে যেন পুরো অভিজ্ঞতা টাই বৃথা। কাচ্চি, তেহারি, নেহারি, হালিমের ভিড়ে সম্পূর্ণ বাংলা খাবারের ভাবটাই যেন আলাদা। বিউটি বোর্ডিং এর দরজা দিয়ে ঢুকলে একটা মনোরম পরিবেশ মনকে নাড়া দেয়। ধ্বংসপ্রায় ভবনের সামনে রয়েছে একটুকরো বাগান, যার পাশে বোর্ডিং এর দপ্তর এবং ক্যাফেটেরিয়া। এই ক্যাফেটেরিয়াতে বসলে যেন একটা নস্টালজিক আবহ চারিদিকে ঘুরে বেড়ায়, মনে হতে থাকে একসময়ে এখানকার চেয়ার টেবিলে বসেই কত শত গুণী ব্যাক্তিদের আড্ডা জমে উঠত। 

সূচনালগ্ন থেকেই এখানকার খাবারের রয়েছে আলাদা সুনাম। খাবার তালিকার আগামাথা পুরোটাই বাংলা খাবারের নাম। বিশেষ কিছু না, তবে চিরচায়িত খাবারের অন্যরকম স্বাদ পাওয়া যায় এই খাবার গুলোতে। অনেকের ভাষ্যমতে, এখানকার খাবার গুলোতে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা খাবারের মত স্বাদ আছে। খাবারের মধ্যে রয়েছে বাহারি ভর্তা – আলু, টমেটো, পটল – চিংড়ি, টাকি, ইলিশ এরকম অনেক। আছে লালশাক সহ কয়েক পদের শাক। আছে তেতুল-বরই- আলুবোখারা চাটনি, আলুর দম,  পাঁচমিশালি সবজি ভুনা (৮-৯ রকমের সবজির সংমিশ্রণ)। বিউটি বোর্ডিং এর সবচেয়ে জনপ্রিয় যে দুইটি পদ, সেটি হল মুড়িঘণ্ট এবং সরষে ইলিশ। এই মুড়িঘণ্ট মুগডালের নয়। মাছের মাথা, কিশমিশ, পোস্ত বাটা এবং পোলাওর চাল দিয়ে রান্না করা হয় এই মুড়িঘণ্ট, যেখানে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের স্বাদ। রয়েছে সরষে ইলিশ, যেটা অন্যান্য খাবারের তুলনায় একটু দুর্লভ, তবে স্বাদে অনন্য। অন্যান্য খাবারের দাম মোটামুটি একই থাকলেও সরষে ইলিশের দাম ওঠানামা করে। সপ্তাহের সাতদিনের একেকদিন এখানে মিলে একেক খাবার। যদি সেখানে গিয়ে ভোজনের পরিকল্পনা করেন, তবে আগে থেকে যোগাযোগ করে বিস্তারিত জেনে যাওয়াই উত্তম। বেলা সাড়ে বারোটা থেকে আড়াইটা অব্দি সব খাবারের উপস্থিতি পাওয়া যাবে। আড়াইটার পর থেকে খাবারের পরিমাণ কমতে থাকে। সেখানে রাতের খাবারও মিলবে, তবে মধ্যাহ্নের মত এত বৈচিত্র্য থাকবে না। 

আবাসিক ব্যবস্থা 

বিউটি বোর্ডিং এ রয়েছে সিঙ্গেল / ডাবল সহ ২৬ টার মত কক্ষ, যেগুলোর ভাড়া ৫০০-৬০০ টাকার মত। বাগানের গাছগুলো থাকার পরিবেশে ছড়িয়ে দেয় মনোমুগ্ধকর এক আভা। শীতল একটা আবহাওয়া সেখানে সবসময়েই বিদ্যমান। 

ছবি- সংগৃহীত

আবাসিক অতিথি না হলেও একটা দিন হাতে নিয়ে এসে এখানে খুব সুন্দর একটি সময় কাটানো যায়। 

কিভাবে যাবেন বিউটি বোর্ডিং 

পুরান ঢাকার বাংলাবাজার এসে যে কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই মিলে যাবে এই বোর্ডিং এর ঠিকানা। নিজের সুবিধার জন্য গুগল ম্যাপেও এর ঠিকানা খুঁজে নিয়ে চলে আসা যেতে পারে। 

 

ফাতেমা নজরুল স্নেহা

Add comment