Porjotonlipi

বাউল লালন শাহ – বাঙালি সংস্কৃতির অহংকার

বাউল শুনলেই প্রথমেই যার নাম মনে পরে সে অন্য কেউ নন, ফকির লালন শাহ। অনেকের কাছে তিনি লালন সাইঁজি, মহাত্মা লালন নামেও, যার পরিচিতি বিশ্বব্যাপী। বাউল লালন শাহের স্মরণে তার শিষ্যরা ও দেশ বিদেশের বাউলকূল গানের আসরের আয়োজন করেন তার আখড়ায়, যা “লালন মেলা” নামে জনপ্রিয়।

বাউল লালন শাহ ও লালন মেলা

বাউল লালন শাহ তার পরিচিতি নিয়ে কখনো কোন কথা বলেনি এবং কোন তথ্যসূত্রও রাখেনি। তার বিভিন্ন গানে তিনি নিজেকে লালন ফকির বলে উল্লেখ করেছেন। লালন নির্দিষ্ট কোন ধর্ম মানতেন না এবং তিনি তার রচিত গানেও ধর্ম – জাত – পাতের প্রতিবাদ করেছেন৷

কথিত আছে, কায়স্থ পরিবারের লালন শাহ কিশোর বয়সে তীর্থ ভ্রমণে বের হয়ে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে তার সঙ্গীরা তাকে ত্যাগ করে। নদীতে ভাসমান অবস্থায় লালন কে দেখতে পায় মতিজান ফকিরানি, নিঃসন্তান থাকায় মতিজান ফকিরানি ও মাওলানা মলম শাহ তাকে নিজ সন্তান হিসেবে গ্রহণ করে। পরবর্তীতে সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে গেলেও মুসলমানের অন্ন-জল গ্রহণ করায় তাকে ত্যাগ করে সমাজ ৷ লালন ফিরে এসে সিরাজ শাহের সাঙ্গ লাভ করেন ও কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়াতে আখড়া গড়ে তোলেন। লালন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহের জমিদার বাড়ির ভাল সম্পর্কের উল্লেখ পাওয়া যায় বেশ কিছু লিখনিতে। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন লেখায় লালন ফকিরের মতাদর্শের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। লালন শাহের মৃত্যুর পর তাকে তার আখড়াতেই সমাহিত করা হয় ও লালন শাহের মাজার নামে পরিচিতি পায়।

লালন শাহের আখড়া 

লালন শাহের আখড়া কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি উপজেলার ছেউড়িয়াতে অবস্থিত ১৪ একর জায়গা জুড়ে। আখড়াতে আপনার চোখে পরবে লালন মাজার, লালন একাডেমি ভবন ও কমপ্লেক্স, পাঠাগার, অডিটোরিয়াম, রিসোর্স সেন্টার ও লালন জাদুঘর।

বাউল লালন শাহ র আখড়ার মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করলেই মাজারের সবুজ মনোরম পরিবেশ আপনাকে সতেজ করে তুলবে। দুপাশে বাগান ও মাঝের রাস্তা ধরে সামনে এগিয়ে গেলেই মাজারের দেখা পাবেন। আর ডান পাশে দেখতে পাবেন হাতে ধরা দোতারার একটি ভাষ্কর্য।

মাজারে লালন শাহের সমাধির পাশে তার পালক মা মতিজান ফকিরানির সমাধিও চোখে পরবে, বাহিরে আছে পালক পিতা মাওলানা মলম শাহর সমাধি। এছাড়াও মাজারে লালন শাহের ৩২ জন শিষ্যের সমাধি রয়েছে।

সামনে এগিয়ে গেলে আছে অডিটোরিয়াম ভবন, যেখানে ভক্ত শিষ্যরা গানের আসর জমিয়ে থাকে, আর এই আসর সারাবছরই চলতে থাকে।

অডিটোরিয়াম ভবনের পাশে আপনার চোখে পরবে একাডেমিক ভবন। একাডেমিক ভবনে আছে লালন জাদুঘর, ১০ টাকা মূল্যের টিকেট কিনে আপনি পরিদর্শন করতে পারবেন লালন শাহের ব্যবহৃত জলচৌকি, হুকো, অলংকার আরও অন্যান্য ব্যবহৃত বস্তু ও চিত্রকর্ম, যা দেখতে হলে আপনাকে ঘুরে আসতে হবে লালন জাদুঘরে।

লালন মেলা 

লালন মেলা বছরে দুইবার আয়োজিত হয়ে থাকে যার দিনক্ষণ ফাল্গুনের দোলপূর্ণিমা ও পহেলা কার্তিক।

প্রথমটি, লালন গবেষকদের মতে লালনের জীবদ্দশায় দোল পূর্ণিমায় দোল উৎসব পালন করা হত এবং যুগযুগ ধরে লালনের শিষ্যরা দোলপূর্ণিমা ও লালন একাডেমি লালন স্মরনোৎসব পালন করে। দ্বিতীয়টি, লালন শাহের মৃত্যুবার্ষিকী ১লা কার্তিকে উদযাপিত হয়।

মাজার প্রাঙ্গণে অডিটোরিয়ামে গানের আসর বসলেও লালন মেলার মূল আয়োজন হয় মাজারের মূলফটকের বিপরীত পাশের মাঠটিতে। মেলার মূল অনুষ্ঠান শুরু হয় রাতে ও তিনদিন ব্যাপি এই মেলায় আগমন ঘটে দেশ বিদেশের বাউল সাধকদের। মাঠের লালন মঞ্চটিতে মেলার সময় দেশের শীর্ষস্থানীয় লালন শিল্পীরা লালন সঙ্গীত পরিবেশন করে থাকেন। মেলার অধিকাংশ স্থানজুড়ে প্যান্ডেল করা থাকে, যার নিচে বাউল সাধকেরা অবস্থান করে আবার মেলার বিভিন্ন আয়োজন সামগ্রীও থাকে।

মাঠের পিছনে আছে বিশাল দিঘি। নিরিবিলি বসে দিঘির শান্ত জলে সময় কাটাতে পারেন আর ভাবতে পারেন শতবর্ষ আগের কোন এক বাউলের কথা যার স্মরণে আজও এত আয়োজন।

মেলায় গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী বায়স্কোপ, নাগরদোলা, নৌকার আনন্দ উপভোগ করতে পারবেন। এছাড়াও বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য পাবেন, এরমধ্যে কুষ্টিয়ার বিখ্যাত কুলফি, তিলের খাজা খেতে পারেন, এবং তিলের খাজা নিয়ে যেতে পারেন পরিবারের জন্যও। কুটিরশিল্পের দোকানগুলো ঘুরে দেখতে পারেন, কিনে নিতেও পারেন বিভিন্ন অলংকার বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় কিছু। কুটিরশিল্পের দোকানগুলো মেলা বাদেও বছরের অন্য সময়গুলোতেও থাকে।

বাংলা মাসের ক্যালেন্ডার মিলিয়ে চলে যেতে পারেন কুষ্টিয়ার লালন শাহের মাজারে ও মেলায়। দোলপূর্ণিমার তিথি অনুযায়ী ইংরেজি মার্চ মাসে প্রথম লালন স্মরনোৎসব ও অক্টোবরের ১৬ তারিখ, বাংলা কার্তিক মাসের ১ তারিখ লালন মেলার আয়োজন হয়ে থাকে।

তবে মেলার সময়গুলোতে ভীর হয় প্রচন্ড। প্রতিদিন প্রায় লক্ষাধিক মানুষের আগমন ঘটে এই মেলায়। তবে মেলার আমেজ উপভোগ করতে চাইলে মেলার সময় যেতে পারেন, আর নইলে মেলা ব্যতিত অন্য সময় গেলে নিরিবিলি ঘুরেও অডিটোরিয়ামের গানের আসর উপভোগ করতে পারেন।

ইতিহাস ও সংস্কৃতি  

সংস্কৃতির রাজধানী কুষ্টিয়া এলে একই দিনে লালন শাহের মাজার ও রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ কুঠিবাড়ি ঘুরে আসতে পারবেন। সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই ভিন্ন জগত উপভোগ করে পরের দিন সকালে রওনা দিতে পারেন পার্শ্ববর্তী ঐতিহাসিক মেহেরপুর জেলা। ভ্রমণ করে আসতে পারেন মুজিবনগর ও ইংরেজ শাশনামলের নীলকুঠি। টাইমট্রাভেলের মত একটানা কিছুদিন কাটবে ইতিহাসের ও সংস্কৃতির পাতায়।

 

কন্টেন্ট রাইটার – সুমাইয়া নাসরিন তামান্না

 

Porjotonlipi Desk

Add comment