Porjotonlipi

১৩টি ভ্রমণস্থান যেখানে পাবেন পৃথিবীর স্বচ্ছতম পানি

দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ক্লান্তি দূর করতে আমরা বরাবরই ছুটে গিয়েছি প্রকৃতির সন্নিকটে। কেউ গিয়েছি সবুজ বনের উদ্দেশ্যে, কেউবা গিয়েছি টলমলে, নীল স্রোতধারার কাছে।

ক্ষণিকের জন্য হলেও প্রকৃতির কাছে গিয়ে মানসিক প্রশান্তি খোঁজার জন্য এমন কিছু দর্শনীয় স্থান আছে যেখানে গেলে দেখা মিলবে পৃথিবীর স্বচ্ছতম পানি । চলুন, বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক। এসব দ্বীপ, সৈকত, হ্রদের পাড়ে গেলে সারিবদ্ধ সবুজের মেলা অথবা ফিরোজা নুড়ির দেখা পাওয়া যায়। বলার বাকি রাখে না এসব ভ্রমণস্থানে বেড়াতে গেলে মানসিক প্রশান্তি একেবারে হাতের নাগালে চলে আসে। পৃথিবীর স্বচ্ছতম পানি দেখার জন্য এই স্থানসমূহ সত্যিই অসাধারণ। তাহলে চলুন ঘুরে দেখে আসি পৃথিবীর স্বচ্ছতম পানি

যেখানে পাবেন পৃথিবীর স্বচ্ছতম পানি

এগ্রেম্নি বীচ, গ্রীস

লেফকাদা দ্বীপের সর্বত্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চোখজুড়ানো মনরম সব দৃশ্যাবলী। কিন্তু সাগরের পূর্ববর্তী উপকূল ‘’এগ্রেম্নি দ্বীপ’’ সৌন্দর্যের এক ভিন্ন বিবরণ দেয়। জায়গাটি খাঁড়া, অমসৃণ সিঁড়ি পেড়িয়ে যেতে হয়, যে কারণে জায়গাটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ, লোকসমাগমও বেশ কম। কিন্তু সত্যিকারের সাগর পিপাসুরা হাজার বাধা অতিক্রম করে ছোট এক টুকরো স্বর্গের কাছে গিয়ে সাদা বালু মাড়িয়ে, নীল পানিতে দেহ ভিজিয়ে, সূর্যের নরম রোদ উপভোগ করে আবার ফিরে আসে।

ক্রেটার হ্রদ, অরেগন

মাযামা আগ্নেয়পর্বতের কিছু অংশ হ্রদের গভীর পানিতে ডুবে থাকার অসাধারণ দৃশ্যটির জন্য ক্রেটার হ্রদ কে আমেরিকার অন্যতম সুন্দর হ্রদগুলোর মধ্যে তালিকাভুক্ত করা যেতে পারে। আশেপাশে কোন নদী বা ঢেউ এর উৎপত্তিস্থল না থাকায় হ্রদটি সবসময় শান্ত যে কারণে এর পানিও কাঁচের মত স্বচ্ছ। নিরব, শান্ত হওয়ার দরুন ডুবুরিদের গভীর সাঁতার দেয়ার জন্য শীতল পানির এই জলাধার কে সবচেয়ে বেশি বেছে নেয়া হয়। ১,৯৪৩ ফিট গভীর এই হ্রদ, যেখানে সূর্যের আলো পৌছায় মাত্র ৪০০ ফিট পর্যন্ত। যুক্তরাষ্ট্রের এই গভীরতম হ্রদটি দক্ষিন অরেগনে অবস্থিত।

কন সান, ভিয়েতনাম

কন দাও – ১৬টি  দ্বীপপুঞ্জের কেন্দ্রস্থল এবং অল্পবিস্তর লোকসমাগম। এই ১৬টি দ্বীপের একটি কন সান যেটি পৃথিবীর লুকায়িত স্বর্গদৌলতগুলোর মধ্যে একটি। এটি গ্রানাইট দেহরেখা এবং স্বচ্ছ পানির দ্বীপ, যেখানে কোলাহল খুব একটা শুনতে পাওয়া যায় না। ভিয়েতনাম থেকে ১১০ মাইল দূরবর্তী দক্ষিন উপকূলে এই দ্বীপের বসতি। জনমানব নগণ্য হওয়ার কারণে দ্বীপটি পুরো নতুনের মত ঝকঝকে পরিষ্কার এবং সুন্দরভাবে পরিপাটি। দ্বীপের উপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে স্বর্ণালী বালুকণা, পাশে রয়েছে ফটিক নীল পানি। নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করার জন্য নির্জন ‘দাম ত্রে’ উপহ্রদও ঘুরে আসা যেতে পাড়ে।

ডেভিল’স বে, ভার্জিন গরদা, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড

বলা হয়ে থাকে, সুন্দর জিনিসের ছোঁয়া পাওয়ার জন্য কাঠখড় পোড়াতে হয়। ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপের অন্তর্গত ‘Devil’s Bay’ এর বেলায় ঠিক এই কথাটাই খাটে। রঙিন নুড়ি পাঁথরের রাস্তা পেড়িয়ে স্থিরচিত্রের মত সাদাবালুর ছোট এক ভূস্বর্গের দেখা মিলে যার নাম Devil’s Bay। নামের মধ্যে একটা কঠিন ভাব থাকলেও জায়গাটার পরিবেশ ঠিক বিপরীত। হাজার কাঠখড় পুড়িয়ে যাওয়ার পর যখন হিমশীতল ফিরোজা পানিতে সাঁতার দিবেন, তখন মনে হবে – কাঠখড় পোড়ানর বদলে যদি এই শান্তি পাওয়া যায়, তবে তাই সই।

প্লিটভাইস লেক জাতীয় উদ্যান, ক্রোয়েশিয়া

যাগ্রেব এর শিল্পনগরি হতে ঘণ্টা দুয়েক এর দুরত্তে রয়েছে প্রকৃতির আরেক ভূস্বর্গ, যেটি প্লিটভাইস লেক ন্যাশনাল পার্ক। এই সবুজ বন মত উদ্যানটি ১৯৭৯ সালে ইউনেস্কো দ্বারা বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী দর্শনীও স্থানের স্বীকৃতি পেয়েছে। পার্কের ভিতরেই রয়েছে ১৬টি ফিরোজা নীল হ্রদ – যা দেখলে প্রকৃতির বিশাল লীলাখেলার ছোঁয়া সহজেই অনুমেয়। কাষ্ঠল আল ধরে সামনের দিকে আগালে পরিষ্কার স্রোতধারার দেখা মিলে – নৌকা করে সমুদ্র পাড়ি দিলে যার মজা আরও বহুগুণে বেড়ে যায়।

অ্যাম্বারগ্রীস কেয়ে, বেলিয

অস্ট্রেলিয়ার সমান্তরাল দ্বীপ থেকে স্বল্পসময়ের নৌকা ভ্রমণ – বেলিয এম্বারগ্রিস এমন এক জলস্বর্গ যেখানে ডুবসাতারুদের খুব সুন্দর একটি সময় কাটবে। Shark Ray Alley হতে ছোট আকারের হাঙ্গর মাছ এবং Stingrays নামক জলজ প্রাণীদের সাথে সাক্ষাত এবং Hol Chan Marine এ কাছিম, রং-বেরঙ্গের মাছ, ঈল এর মত জলজ প্রাণীদের কাছ থেকে দেখার সুযোগ অথবা সাগরের নিছে নীল গহ্বরে সাঁতার দেয়া – সব এক জায়গা থেকেই করে আসা যেতে পাড়ে। পানিতে না নাম্লেও পাড়ে বসে প্রকৃতির সবুজ রঙকে একান্ত মনে উপভোগ করার সুযোগ ও সেখানে রয়েছে – যেখানে বেড়াতে গেলে সতেজ মন নিয়ে আবার শহুরে জীবনে ফিরে জীবনকে নতুন উদ্যমে কাটানো যাবে।

পঞ্চফুলের হ্রদ, জিউঝাইগো জাতীয় উদ্যান, চায়না

ইউনেস্কো দ্বারা বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় স্থানের তালিকাভুক্ত, অসাধারন ঝর্ণার পানির নীচে পতিত হয়ে পরিষ্কার নীল পানিতে পরিণত হওয়া হ্রদটি চায়নার সিচুয়ান প্রদেশে অবস্থানরত। উদ্যানের আকর্ষণের মধ্যমণি এই স্বচ্ছ জলাধার পঞ্চফুল হ্রদ বা Five-Flowers Lake । এই হ্রদের পানি এতটাই পরিষ্কার, যেখানে উপর থেকে চোখ বোলালে পানির নিচে সব কিছু স্পষ্ট দেখা যায়। আরেকটি মজার ব্যাপার হল, হ্রদের আশেপাশে বড় হয়ে ওঠা সরু গাছগুলো পানিতে ছায়া ফেলে পানির নিচের মাটিতে সুন্দর রেখাপাত সৃষ্টি করে- যে দৃশ্য মানুষের চোখদৃষ্টি কে শীতল করে দেয়। এই হ্রদের অপর নাম ‘আয়না হ্রদ’ও রাখা যেতে পারে কারন হ্রদের মধ্যে আশেপাশের দৃশের একদম দর্পণন্যায় প্রতিবিম্ব ভেসে ওঠে যা দেখতে কিছুটা অতিপ্রাকৃত।

হেভলক দ্বীপ, ভারত

সুদুরপ্রসারিত এই দ্বীপস্বর্গটি আন্দামান দ্বীপ এবং বঙ্গপসাগরের মাঝে যোগসূত্র হিসাবে কর্মরত। এই স্বর্গে যাওয়া দুঃসাধ্য বটে, কিন্তু যারা অসাধ্য পাড়ি দিতে যেকোনো সীমারেখা অতিক্রম রাজি, তারাই শুধুমাত্র নগরের কোলাহল থেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে নিশ্চুপ ভাবে অপক্ষারত এই জলস্বর্গের সাদা বালুর নরম ছোঁয়া , নীলাভ-সবুজ জলরাশি এর সঙ্গ উপভোগ করতে পারবে।

আইলা দে রসারিও, কলাম্বিয়া

জিবন্ত প্রানের ধরাছোঁয়ার বাইরে, কারটাজেনা উপকূলের পার্শ্ববর্তী ক্ষুদ্র কিন্তু নজরজুড়ানো নীল জলাধার এর বসতি। জলের একপাশে কলাম্বিয়ার ঘন সবুজ সুদীর্ঘ বন, অন্যপাশে শায়িত ছোট্ট উপহ্রদ যেখানে হাজারো ক্রান্তীয় প্রাণীকুলের বসবাস। আইলা গ্রান্দে তে অবস্থিত হোটেলগুলো আপনি চাইলে রসারিও দ্বীপে যাওয়ার জন্য নৌকা ভ্রমণ এর আয়োজন করে দিতে পারবে।

পেয়ত হ্রদ, আলবার্টা, কানাডা

বানফ জাতীয় উদ্যানে অবস্থানরত হ্রদটি হিমশীতল পানি দ্বারা পরিপূর্ণ যার মধ্যে নীল বর্ণের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। নীল রত্নের মত দেখতে হ্রদটির সবচেয়ে ভাল দর্শন পাওয়া যায় ধনুক চূড়ার উপরে অবস্থান করলে। ধনুক চূড়া সেই জায়গা যেখান থেকে এই রত্নহ্রদের স্থিরচিত্র ধারণ করা বিভিন্ন পোস্ট কার্ডে ছাপানোর জন্য। অকুতোভয় অনেক পর্যটক পাহাড়ের চূড়া বেয়ে নেমে এই হ্রদের সৌন্দর্য দুচোখ ভরে মনে স্থানান্তর করে। গরম ঝর্ণার পানিতে জীবধার ভিজিয়ে ক্লান্তি দূর করে এক নতুন জিবনের উদঘাটন করা যেতে পারে।

দ্বীপের রাজ্য মালদ্বীপ

সমুদ্রপ্রেমীদের ভ্রমণ তালিকায় যে রাজ্যের নাম সবার আগে আসে সেই রাজ্যের নাম মালদ্বীপ। দূরদর্শন যুগের তারকারাজি সহ সাধারন পর্যটকদের পিপাসা মেটানোর অসাধারন খমতা রাখে এই মালদ্বীপ। দ্বীপাঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও আরব এবং ভারত মহাসাগরের এই রাজ্যে বিলাসবহুল ভাড়া করা বাংলোর দেখা মিলে। বাংলো নিবাসের সামনে গেলে পাউডারের মত নরম, সাদা বালুর দ্বীপ নজর কাড়ে। মোদ্দা কথা, এই দ্বীপরাজ্যে বেড়াতে গেলে ভ্রমন পিপাসুদের ভ্রমণ তালিকার অধিকাংশই পুরন হয়ে যাবে। প্রাকৃতিক ছোঁয়া অনুভবের পাশাপাশি মালদ্বীপে পর্যটকদের জন্য রয়েছে আরও অনেক কিছু, যেমন- কোরাল হ্রদ, পানির নিচের বিশেষ খেলাঘর। আরও আছে বিশ্বের অন্যতম আরাদায়ক স্পা।

পালাওয়ান, ফিলিপাইন

ম্যানিলা থেকে স্বল্প দুরত্তের আকাশ যাত্রা হওয়া সত্ত্বেও পালাওয়ান গেলে মনে হবে এ যেন পৃথিবী বহির্ভূত কোন এক হারিয়ে যাওয়া জলধারা। স্বল্প জনমানবের উপস্থিতিতে এই দ্বীপপুঞ্জ জঙ্গলে ঘেরিভূত এবং রয়েছে সবুজাভ পানির ছোট্ট এক জলরাজ্য। জলরাজ্যটি মাছে পরিপূর্ণ, আশেপাশে আছে কয়েকটি উপহ্রদ, গুহা এমনকি লুকানো কিছু অপূর্ব সুন্দর দ্বীপ। এল নিদো কিংবা লিনাপাকান দ্বীপের নীল সাগরে এর সরু হ্রদে সাঁতার দিলে দেখা মিলবে ছোটবড় হরেক পদের মাছরাশির। কেও কেও আবার সাহস করে সুগম পাতাল নদে গা ভাসায়।

তো সুয়া ওশেন ট্রেঞ্চ, সামোয়া

লোকমুখে ‘’দি বিগ হোল’’ নামক স্থানীয় সাঁতারস্থল যেটি দক্ষিন প্রশান্তে অবস্থানরত, এটি প্রকৃতির জন্য এক বিস্ময় বটে। সামোয়া’র বাইরে এই জলরাশির স্বচ্ছ সবুজাভ পানি ছুয়ে উপভোগ করার জন্য পর্যটকদের উচ্ছল শ্যামলিমা পেড়িয়ে, আগ্নেয় মাঠ অতিক্রম করে পৌঁছানো লাগে, যেটি বেশ কষ্টসাধ্য। সেখানে গিয়ে ১০০ ফিট গভীর পানিতে ঝাঁপ দেয়ার জন্য হয়তোবা খাঁড়া সিঁড়ি বেয়ে নামতে হবে অথবা সাহস করে লাফ দিতে হবে। যেহেতু পানির স্রোত সরাসরি আগ্নেয় নল থেকে আগত হয়ে সমুদ্রের সাথে মিশে, তাই খেয়াল রাখতে হবে লাফ দেয়ার সময় সেখানকার পানি যেন কম না থাকে।

আপনার মন্তব্য দিন

বিচিত্র সব জায়গার আমাদের এই প্রতিবেদন সম্পর্কে আপনাদের কোন মতামত বা জিজ্ঞাসা থাকলে আমাদের জানাতে পারেন। আর ভ্রমনের সময় এমন কিছু করবেন না যা আমাদের পরিবেশ, প্রকৃতি এবং সর্বোপরি আমাদের পর্যটন শিল্পের জন্য হুমকি স্বরূপ। আগামী পর্বে আরো কিছু চমক নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হবো। আশা করছি পর্যটনলিপির সাথেই থাকবেন, ধন্যবাদ।

কন্টেন্ট রাইটারঃ ফাতেমা নজরুল স্নেহা

 

Porjotonlipi

1 comment