প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তিতে সাকরাইন উৎসব উদযাপিত হয়ে থাকে। পুরান ঢাকাকে ঘিরে মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। শহরটি পুরনো আদলের হলেও এর ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি মানুষকে সবসময়েই আকৃষ্ট করেছে। শহরটির আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন পুরনো মসজিদ, মন্দির, বিচিত্র রকমের দালান, খাবারের দোকান এবং রয়েছে সংস্কৃতিমনা মানুষ। পুরনো ঢাকায় ঈদ, পূজা-পার্বণ, বড়দিন এবং অন্যান্য ধর্মীয় উৎসব যেমন সৌহার্দ্য-সহমর্মিতায় উদযাপন করা হয়, তেমনি উদযাপন করা হয় ধর্মহীন, সার্বজনীন অনেক উৎসব।
পুরান ঢাকার পৌষ সংক্রান্তির সাকরাইন উৎসব
সেই ধর্মহীন, সার্বজনীন উৎসবের মধ্যে সবচেয়ে জাঁকজমক রূপ নেয়া উৎসবটি হচ্ছে সাকরাইন উৎসব বা ঘুড়ি উৎসব। ইংরেজি বর্ষপঞ্জির জানুয়ারি মাসে এবং বাংলা বর্ষপঞ্জির পৌষ মাসের শেষ তারিখে এই উৎসব পুরান ঢাকার মানুষরা বেশ ঘটা করে উদযাপন করে। “সাকরাইন” শব্দের উদ্ভব “সংক্রাণ” থেকে, যার আভিধানিক অর্থ বিশেষ মুহূর্ত। মোদ্দাকথা, কোন বিশেষ মুহূর্তকে উদ্দেশ্য করে যে উৎসব উদযাপন করা হয়, সেতাই সাকরাইন। এই সাকরাইনে পুরান ঢাকা সেজে যায় এক রঙিন রূপে। ভোর বেলা থেকে শুরু হয়ে যায় উৎসবের ছটা, চলে বেশ রাত পর্যন্ত।
ফিরে দেখি বর্ণিল ইতিহাস
সাকরাইন হচ্ছে এক ধরনের ঘুড়ি উৎসব। পুরান ঢাকায় পুরনো যেসব উৎসব যুগের পর যুগ পালিত হয়ে আসছে, তার মধ্যে এই সাকরাইন ই অন্যতম। এই সংক্রান্তিকে কেন্দ্র করে দক্ষিন এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেই এই উৎসব পালিত হয়ে থাকে। দেশ থেকে দেশান্তরে অতিবাহিত হয়ে আসতে আসতে এটি পুরান ঢাকার একটি সার্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। ভারতবর্ষে এই উৎসবের নাম “মকর সংক্রান্তি” এবং বঙ্গদেশে এটাকে “পৌষ সংক্রান্তি” নামেই ডাকা হয়। ঘুড়ি ওড়ানোর পাশাপাশি হিন্দু সম্প্রদায় আয়োজন করে একটি বিশেষ পূজার, যার নাম “মকর পূজা”। প্রাচীন ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ১৭৪০ সালের পৌষ মাসের শেষ এবং মাঘ মাস শুরুর সন্ধিক্ষণে মোঘল আমলে নায়েব-ই-নাজিম নওয়াজেশ মোহাম্মদ খান এর আমলে ঘুড়ি উৎসবের প্রচলন চালু হয়। কালের পরিক্রমায় এই দিনটি পুরান ঢাকাইয়াদের একটি অন্যতম উৎসব এবং আমেজে পরিণত হয়েছে।
এই উৎসব উপলক্ষে লালবাগ থেকে কদমতলী পর্যন্ত বেশ জমকালো আয়োজন করা হয়ে থাকে। তবে ফরাশগঞ্জ, গেন্ডারিয়া, নারিন্দা এবং চকবাজারে এই সাকরাইন উৎসবের প্রধান্যটা তুলনামূলক একটু বেশি। যে কারণে নতুন ঢাকা এবং অন্যান্য জেলা হতে ব্যাপক মানুষ এই উৎসব উপভোগ করতে ছুটে আসে। প্রায় সমস্ত বাড়ির ছাদে দেখা যায় তরুন প্রাণের মেলা, এবং সন্ধ্যার আকাশে দেখা মিলে রঙিন আতশবাজি এবং ফানুশের খেলা – এই সব কিছুর উপস্থিতিতে পুরান ঢাকা সাজে ওঠে বর্ণিল এক রূপে।
দিনব্যাপী উৎসবের বর্ণনা
একসময়ে এই দিনটি তরুন সমাজ শুধু ঘুড়ি উড়িয়েই পার করত। কিন্তু সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে উৎসবটি নিয়েছে জাঁকজমক এক রূপ। এখন ঊষা হওয়ার সাথে সাথে সাকরাইন উৎসব শুরু হয়। তরুণ প্রাণ সকাল থেকে দুপুর পাড় করে বাদ্য বাজনার শব্দে এবং ঘুড়ি উরিয়ে। আকাশে উড়ে নানা রং এবং আকারের ঘুড়ি। তরুণদের মাঝে চলে ঘুড়ি কাটাকাটির প্রতিযোগিতা। নানা কসরতে ঘুড়ি কাটাকাটি চলার পাশাপাশি শুনতে পাওয়া যায় উৎসাহের “বাকাট্টা” চিৎকার। বিকাল হওয়ার সাথে শুরু হয় আতশবাজি, ফানুশ এবং মশালের খেলা। এই সাকরাইন উৎসবেও চলে অতিথি আপ্যায়নের প্রতিযোগিতা। বাড়ির ছাদে ছাদে মানুষের মিলনমেলা দেখা যায়, ছাদগুলো সেজে উঠে রঙিন আলোকসজ্জায়। দিনটির আমেজ উপভোগ করে ছেলেবুড়ো সবাই। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং সাংবাদিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পৌষ সংক্রান্তি পেয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা।
ঘুড়ি, আতশবাজি এবং ফানুশের গপ্পো
পুরান ঢাকায় যারা অনেক আগে থেকে সাকরাইন পালন করে আসছে, তাদের কমবেশি সবাই বিভিন্ন রকমের ঘুড়ি এবং আতশবাজির নাম বলতে পারবেন। ঘুড়ি গুলোর নাম বেশ বিচিত্র। এই যেমন – চোখদার, রকদার, গরুদার, ভোমাদার, কাউঠাদার, মাছলেঞ্জা, ফিতালেঞ্জা, একরঙা, চানতারা, সাপঘুড়ি, প্রজাপতি ঘুড়ি, পেঁচা ঘুড়ি, বাক্স ঘুড়ি আরও অনেক। আতশবাজির মধ্যে আছে পাঁচ শট, বারো শট, একুশ শট, বত্রিশ শট, আশি শট, একশ বিশ শট, দেড়শ শট, কদম ফুল, তাঁরা শট, ঝর্ণা, ব্যাটারি বোম, চকলেট বোম, শলতা বোম, রকেট বোম, পাতা বোম / ২৮ বোম, ফ্লেম টর্চ। ফানুশেরও রয়েছে হরেক পদ। যেমন – গোল ফানুস, হার্ট ফানুস, চারকোণা ফানুস। এরপর আসে আরেক আকর্ষণ – আগুন খেলা বা মশাল। মুখে কেরোসিন নিয়ে আগুনের মশালে ছুঁড়ে মারা হয়, সৃষ্টি হয় আগুনের ফুলকি। এই খেলা সকলের আয়ত্তের ব্যাপার নয়, কৌশলরপ্ত ছেলেরাই এই মশালের খেলা দেখিয়ে থাকে।
মুখরোচক খাবার
সাকরাইন উৎসব পুরান ঢাকাইয়াদের কাছে ঈদ, পার্বণের চেয়ে কম নয়। প্রায় সকলের ঘরেই এদিন রান্না হয় হরেক পদের খাবার, যেমন – খিচুরি, কাচ্চি, বিরিয়ানি, তেহারি, মোরগ পোলাও, পিঠাপুলি, চটপটি – ফুচকা, রেশমি জিলাপি। সারাদিন ঘুড়ির পিছনে ছুটে চলার পাশাপাশি চলে পরিবার পরিজন নিয়ে ধুমধাম করে খাওয়ার প্রতিযোগিতা।
কোথায় এবং কখন যাবেন
পুরান ঢাকার সব জায়গাতেই চলে এই উৎসবের খেলা। তবে পুরান ঢাকার শাঁখারি বাজার, তাঁতীবাজার, লক্ষ্মীবাজার, সূত্রাপুর, গেণ্ডারিয়া, হাজারীবাগ, নবাবপুর, শ্যামবাজার, ধূপখোলা, ফরাশগঞ্জ, নারিন্দা, চকবাজার, লালবাগ এর মত এলাকায় এর আমেজ সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়।
সাকরাইন উৎসব সকাল থেকেই শুরু হয়। তবে বিকাল থেকে এই উৎসবের আমেজ বেড়ে যায় কয়েক গুণ, চলে গভীর রাত অবধি।
প্রয়োজনীয় সতর্কতা
সার্বজনীন এই উৎসবের আনন্দ অনেকটাই ফিকে হয়ে যায় যখন সামান্য অসতর্কতার কারণে কোন দুর্ঘটনা ঘটে। প্রতি বছরই সাকরাইন উৎসবে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে, ঘটে অভিজ্ঞ লোকের অনুপস্থিতে আতশবাজির এবং আগুন খেলার দুর্ঘটনা। কিন্তু সামান্য কিছু সতর্কতা মেনে চললেই এই সার্বজনীন উৎসবের আনন্দ বেড়ে যাবে কয়েকগুন।
[…] গোলাপ প্রজারা আমার চোখকে মুগ্ধ করার উৎসবে মেতেছিল। লাল লাল পরীদের মৃদু নৃত্য […]