পদ্মা নদী বাংলাদেশের বৃহত্তম নদীগুলোর মধ্যে একটি। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে সজ্জিত দেশ আমাদের এই রূপসী বাংলাদেশ। নদীমাতৃক এই দেশের বিভিন্ন জেলার বিস্তৃত অংশ জুড়ে শাখা -প্রশাখার ন্যায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রায় ৩১০ টি নদ- নদী।
পদ্মা নদী – এক আশার আলো
সব্যসাচী কবি সৈয়দ শামসুল হক, তাই তো নিজের আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে তার কবিতায় বলেছিলেন,
“তেরো শত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে?“
কবি তার কবিতায় বাংলার পলিমাটি আর আলপথের কথা বললেও, বুক ভরা নীল আকাশ আর কবির চোখের বিশ্বাসে এই সত্যকে গভীরভাবে উপলব্ধি করা যায়, এই নদীমাতৃক দেশের প্রতিটি নদীর বাঁকের সাথে জড়িয়ে আছে এই দেশের মানুষের সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা, ভালোবাসা এবং উচ্ছ্বাস।
তবুও কোথায় যেনো, নদীর প্রবাহমান বাঁধাগ্রস্থ ; যেনো নদীর টুঁটি চেপে ধরে বসেছে, অপরিকল্পিত সেতু, নদীভরাট এবং দূষণ। ফলশ্রুতিতে, নাব্য নদী হারিয়ে ফেলছে নাব্যতা, সেই সাথে হারিয়ে ফেলছে বাণিজ্যিক সুবিধা। তবুও অনুকূলের আশায় প্রতিকূলে দাঁড়িয়ে আশার বানীই যেনো শোনাচ্ছে পল্লীগীতি আব্দুল আলীমের “সর্বনাশা পদ্মা নদী”।
কীর্তিনাশা পদ্মা নদীর ভাঙন
পদ্মা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নদী। এর ভাঙন প্রবণতা ও প্রলয়ংকরী স্বভাবের কারণে এর নামকরণ করা হয় ‘কীর্তিনাশা’ বা রাক্ষসী পদ্মা। বলা হয়ে থাকে রাজা রাজবল্লভের কীর্তি পদ্মায় বিনাশ হয়, তাই এর অন্য নাম কীর্তিনাশা। বাংলাদেশের জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলোতে প্রকাশিত ইফতেখার মাহমুদ লিখিত “বিশ্বে সবচেয়ে ভাঙন পদ্মা” নামক শিরোনামের প্রবন্ধে একটি তথ্য তুলে ধরা হয়েছিলো, যা আলোকপাত করে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশবিষয়ক সংস্থা নাসার একটি গবেষণায়। উল্লেখ্য, ১৯৬৭ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়ে ৬৬ হাজার হেক্টরের (প্রায় ২৫৬ বর্গমাইল বা ৬৬০ বর্গকিলোমিটার) বেশি এলাকা পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে, যা ঢাকা শহরের আয়তনের প্রায় আড়াই গুণের সমান। প্রাচীন চীনে হুয়াংহো নদী সবকিছু বন্যায় ভাসিয়ে দিত বলে সকলে আক্ষেপ করে বলতো চীনের দুঃখ হোয়াংহো। পরবর্তীতে নতুন চীন সরকারের সুষ্ঠু পরিকল্পনা আর প্রযুক্তির উৎকর্রষতার প্রেক্ষিতে সেই দুঃখটুকু কিছুটা হলেও ঘুচানো সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে, সকল ধরণের প্রতিবেদন অনুযায়ী পদ্মা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে ভাঙনপ্রবণ নদী যার কারণে আতঙ্কগ্রস্থ এইদেশের বিভিন্ন জনপদের মানুষ। তার মধ্যে শরীয়তপুর, হরিরামপুর প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। প্রায় প্রতিবছরই পদ্মার ভাঙন নিয়ে পত্রিকায় লিখতে হয়। এক অনিবার্য বাস্তবতাকে কলমের খোঁচায় প্রকাশ করা যেনো এই দেশের কবি -সাহিত্যিক -লেখকদের জন্য রীতিমত ডালভাত হয়ে গেছে। তাই তো কবি আল মাহমুদ অকপটে বলতে পেরেছিলেন, নদী ভাঙনে ঘরহারা, কষ্টে জর্জরিত এক কিশোরের জবানিতে
‘অভিযোগহীন এমন রোদনধ্বনি কখনো শুনিনি আর’
কঠিন এই বাস্তবতা সমাধানকল্পে অনেকে বাঁধপ্রকল্পের কথা ভাবছেন। দৈনিক ইত্তেফাকের সূত্রমতে হরিরামপুরে বাঁধ প্রকল্পের কথা চিন্তা করছে মানিকগঞ্জের পানি উন্নয়ন বোর্ড। যদিও চলতি অর্থবছরে বাজেট পাসের উপর নির্ভর করছে বিষয়টি।
পদ্মা নদীর আশার আলো
রাক্ষুসে পদ্মার করাল গ্রাসে নদীর তীরবর্তী মানুষ তার সর্বস্ব হারালেও, সেই দুঃখে আশার বার্তা যোগাচ্ছে, পদ্মা সেতু। সেই সাথে পদ্মায় আবারো নতুন করে জেগে উঠেছে কিছু চর। কৃষকেরা সেই চরে সফলভাবে ফসল উৎপাদন করছে। উৎপাদিত ফসল দেশের সকল প্রান্তে পৌঁছে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে স্বপ্নের সেতু পদ্মা।
পদ্মার চরে চাষাবাদ
ভরা মৌসুমে পদ্মার উত্তাল ঢেউ এর পর দেখা মেলে অবিরত চর। শীত থেকে গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ে মাস পানি কম থাকে নদীতে। এ সময় পদ্মার পাড় সংলগ্ন এলাকায় জেগে ওঠে চর। আর সেই চরে ফলানো হয় সবুজ ফসল। দেশের দৈনিক পত্রিকার তথ্যানুসারে, প্রায় দুই যুগ আগে পদ্মা নদীর ভাঙনে বিলীন হয়ে যায় কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার রামকৃষ্ণপুর আর চিলমারী ইউনিয়ন। তবে কয়েক বছর ধরে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এ বিস্তীর্ণ পদ্মার চরে শুরু হয়েছে নানা ফসলের আবাদ। রবি মৌসুমে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকার ফসল উৎপাদন হবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের। এতে নতুন করে আশার আলো দেখছেন চরের হাজারো মানুষ।
ব্যক্তিগত অভিমতের জায়গা থেকে বললে এটি অনেক ভূমিহারা কৃষকের অবস্থার উন্নতিতে ভূমিকা রাখবে। এটি তাদের জন্য একটি সুখবার্তা।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু
পদ্মা সেতু কে বাংলাদেশের স্বপ্নের সেতু বলা হয়। এর নামকরণের পেছনের যৌক্তিকতা সম্পর্কে জানতে হলে অবশ্যই এটি তৈরি করার পটভূমি সম্পর্কে জানতে হবে।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০২২ সালের জুন মাসের মধ্যে স্বপ্ন ও গর্বের এ সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথা রয়েছে। ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক কথিত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন থেকে সরে যাওয়ার পর সংস্থাটিকে অনুসরণ করে আরও তিনটি দাতা সংস্থা পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন থেকে সরে যায়। ফলে নিজেদের উদ্যোগ ও অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের সাহসী পদক্ষেপ বিশ্বে আমাদের সক্ষমতার বিষয়ে নতুন ধারণার জন্ম দিয়েছে। এজন্য এই সেতু আমাদের কাছে স্বপ্নের চেয়েও বেশি কিছু।
পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে সরাসরি তিন ধরনের পরিবর্তন আসবে। সেতুটিতে ভবিষ্যতে রেল, গ্যাস, বৈদ্যুতিক লাইন এবং ফাইবার অপটিক কেবল সম্প্রসারণের ব্যবস্থা রয়েছে। এই সেতুটি নির্মিত হলে দেশের জিডিপি ১.২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে।
অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি
সেতু টি নির্মাণের ফলে যে সকল ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসবে তা হলো, প্রথমত, মাওয়া এবং জাজিরা পয়েন্ট দিয়ে এই সেতু এর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে। ফলে ওই অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তার লাভ করবে, বিনিয়োগ বাড়বে। পদ্মা বহুমুখী সেতুটি চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রধান গেটওয়ে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর, বেনাপোল-ভোমরা স্থলবন্দরের সঙ্গে সংযোগ তৈরি হবে। বিশেষ করে আঞ্চলিক সংযোগ বা রিজিওনাল কানেকটিভিটিতে অন্যতম ভূমিকা রাখবে এই সেতু। শুধু অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য নয়, আঞ্চলিক বাণিজ্যের গেটওয়ে হিসেবেও বিচেনা করা হচ্ছে পদ্মা বহুমুখী সেতুকে।দ্বিতীয়ত, কৃষক সরাসরি উপকৃত হবেন। তারা তাদের উৎপাদিত পচনশীল পণ্য রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরাসরি পাঠাতে পারবেন। ফলে পণ্যের ভালো দাম পাওয়ার মধ্য দিয়ে উৎপাদনে মনোযোগী হবেন তারা, যা আমাদের কৃষি খাতে ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে। তৃতীয়ত, পদ্মা সেতুর মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তৃতি ঘটবে। এমন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সার্বিক নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণে যাতে কোনোরকম ঘাটতি বা ত্রুটি না হয়, এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে।
চতুর্থত, পদ্মা সেতু চালুর পর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য আরও সম্প্রসারিত হবে শুধু তাই নয়, বর্তমানে বেনাপোল বন্দর থেকে আমদানিকৃত পণ্য ঢাকায় আনতে যে সময় লাগে, সেতু চালুর পর তা অনেকাংশে কমে আসবে।
জাতীয় কবি হয়তো দেখে ঠিকই বলেছিলেন পদ্মার ঢেউ রে —মোর শূণ্য হৃদয়–পদ্ম নিয়ে যা, যা।
কবির শূন্য হৃদয়কে একমাত্র পদ্মাই পারে তার ঢেউয়ের স্রোতে ভরিয়ে দিতে।
নদীমাতৃক এই দেশের পদ্মাই একমাত্র নদী যে একাধারে সর্বস্বহারা কৃষকদের কাছে সর্বনাশা, সর্বগ্রাসী ঠিক তেমনি আলোবর্তিকা হাতে এক মহানুভব রুপসী। পদ্মায় পারে তার বুকের চর জাগিয়ে প্রমাণ করতে, সে যেমন রিক্ত করতে পারে, ঠিক তেমনি দুহাত ভরে দিতেও পারে। আশার আলো হয়ে পদ্মা নদীর বুকে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের স্বপ্নের “পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প ” যা এনে দিবে আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। নিজস্ব অর্থায়ানে একটি প্রকল্প নামানো এবং দেশের জিডিপি বৃদ্ধি করার পেছনে পদ্মার ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই এই দেশের নানান গুণীজনের মতো আমারো উপলব্ধ, পদ্মার ঢেউ তে যেনো আসে কেবল সমৃদ্ধি আর সমৃদ্ধি।
Add comment