বন্ধুরা পর্যটনলিপির আয়োজনে আজ আপনাদের জন্য রয়েছে বাংলার এক অপার সৌন্দর্য্য “নিঝুম দ্বীপ”। নোয়াখালী জেলার দক্ষিণে মেঘনা নদীর মোহনায় অবস্থিত হাতিয়া উপজেলার সর্বদক্ষিণে নিঝুমদ্বীপের অবস্থান। বাংলাদেশের একটি ছোট দ্বীপ এটি। মূলত এটি একটি চর। ২০০১ সালের ৮ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার পুরো দ্বীপটিকে উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে। নোয়াখালী, চর ওসমান, কামলার চর এবং চর মুরি এই চারটি দ্বীপের মোট ১৬,৩৫২.২৩ হেক্টর এলাকা নিয়ে উদ্যানটি গঠিত।
নিঝুম দ্বীপ এর ইতিকথা
১৯৪০ এর দশকে এই দ্বীপটি বঙ্গোপসাগর হতে জেগে উঠা শুরু করে। চর গঠনের বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে ৪০ এর দশকের শেষদিকে নিঝুমদ্বীপ তৃণচর বা গোচারণের উপযুক্ত হয়ে উঠে। মাছ ধরতে গিয়ে হাতিয়ার জেলেরা নিঝুমদ্বীপ আবিষ্কার করে। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি নিঝুমদ্বীপে জনবসতি শুরু হয়। মূলত হাতিয়ার জাহাজমারা ইউনিয়ন হতে কিছু জেলে পরিবার নিঝুমদ্বীপে আসে। নিঝুমদ্বীপ সংলগ্ন এলাকায় প্রচুর ইছা মাছ ( চিংড়ি মাছ ) ধরা পড়তো বিধায় জেলেরা এই দ্বীপের নাম দেয় ” ইছামতির দ্বীপ “। এই দ্বীপটিতে মাঝে মাঝে বালির ঢিবি বা টিলার মতো ছিল বিধায় স্থানীয় লোকজন এই দ্বীপটিকে বাইল্লার ডেইল বলে ডাকতো। কালক্রমে ইছামতী দ্বীপ নামটি হারিয়ে স্থানীয় লোকেরা এখনো এই দ্বীপকে বাইল্লার ডেইল বলেই সম্বোধন করে। নিঝুম দ্বীপ বা বাইল্লার ডেইল যে নামেই হোক না কেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের দিয়ারা জরিপ বিভাগ এই দ্বীপের জমি চর ওসমান মৌজা হিসেবে জরিপ করে। কথিত আছে সরদার ওসমান নামের এক সাহসী বাথানিয়া ১০০ মহিষ নিয়ে প্রমত্তা মেঘনা পাড়ি দিয়ে প্রথম এই দ্বীপ এ আসে এবং দিয়ারা জরিপ কর্মচারীদেরকে জরিপ কাজে প্রভূত সহায়তা করে বিধায় তাঁর নাম অনুসারে নিঝুম দ্বীপের মৌজার সরকারি নাম হয় চর ওসমান। নিঝুম দ্বীপের পূর্ব নাম ছিল চর ওসমান। পরে হাতিয়ার সাংসদ আমিরুল ইসলাম কালাম এই নাম বদলে নিঝুম দ্বীপ নামকরণ করেন। নিঝুম দ্বীপে রয়েছে ৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো সাইক্লোন শেল্টারে অবস্থিত।
নিঝুম দ্বীপ ও তাঁর প্রকৃতি
সমগ্র নিঝুম দ্বীপের প্রায় ৩০০০.০০ একরে মানুষের বসতি রয়েছে এবং অবশিষ্ট অংশে ম্যানগ্রোভ বনায়ন রয়েছে। ইছামতির দ্বীপ, বাইল্লার চর বা চর ওসমান যে নামেই স্থানীয়ভাবে প্রচলিত হোক না কেন ৮০ এর দশকের শুরু হতে এই দ্বীপটি বাংলাদেশের জনগণের নিকট নিঝুম দ্বীপ হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে নিঝুম দ্বীপে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয় হল এখানকার হরিণ। মূলত ১৯৭০ খিস্তাব্দের আগ পর্যন্ত কোন লোকবসতি ছিল না এখানে। তাই দ্বীপটি ছিল জনমানবশূন্য নিঝুম। এরপর বাংলাদেশের বনবিভাগ ৭০ এর দশকে এখানে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে চার জোড়া হরিণ ছাড়া হয়। বর্তমানে নিঝুম দ্বীপ এখন হরিণের অভয়ারণ্য।
প্রাণীদের নতুন ঠিকানা
১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দের হরিণশুমারী অনুযায়ী হরিণের সংখ্যা ২২,০০০। চিত্রা হরিণই নিঝুম দ্বীপের প্রধান বন্য প্রাণী। একর প্রতি চিত্রল হরিণের ঘনত্ব সুন্দরবনের চেয়ে তিনগুন বেশী। এখানে বাঘের মতো কোন মাংসাশী প্রাণী না থাকায় দ্রুত গতিতে বংশ বৃদ্ধি হচ্ছে। অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে রয়েছে উদয়ী নখরবিল উদবিড়াল, মেছো বাঘ ইত্যাদি। এছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির পাখির মধ্যে রয়েছে নিশি বক, দেশি কানিবক, গোবক, দেশি পানকৌড়ি, ধূসর বক, কাদাখোঁচা, বালিহাঁস, কালোহাঁস, কোঁড়া, তিল লালপা, তিল সবুজপা ইত্যাদি। এই উদ্যান দেশি গাঙচষার অন্যতম প্রধান বিচরণস্থল। সরীসৃপের মধ্যে রয়েছে দেশি গুইসাপ ও অন্যান্য জাতের সামুদ্রিক কচ্ছপ। সামুদ্রিক কচ্ছপের গুরুত্বপূর্ণ প্রজননস্থল এই নিঝুম দ্বীপ। নিঝুম দ্বীপে রয়েছে কেওড়া গাছ। ইদানিং বনবিভাগ কিছু নোনা ঝাউ রোপণ করেছে। এছাড়াও রয়েছে প্রায় ৪৩ প্রজাতির লতাগুল্ম এবং ২১ প্রজাতির অন্যান্য গাছ।
সুন্দরবনের ছোঁয়া
নোনা পানিতে বেষ্টিত নিঝুম দ্বীপ কেওড়া গাছের অভয়ারণ্য। ম্যানগ্রোভ বনের মধ্যে সুন্দরবনের পরে নিঝুম দ্বীপকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন বলে দাবি করা হয়।
গন্তব্যের পথ
আপনি যদি নিঝুম দ্বীপ যেতে চান তাহলে আপনাকে নোয়াখালী জেলা সদর মাইজদি হতে প্রথমে সোনাপুর বাসস্ট্যান্ড যেতে হবে। সেখান থেকে চেয়ারম্যান ঘাটগামী যেকোনো লোকাল বাস সার্ভিস/ সিনজি যোগে চেয়ারম্যান ঘাট নামতে হবে। অতঃপর লঞ্চে নলচিরা ঘাটে নেমে সিনজি যোগে জাহাজমারা ঘাটে গিয়ে নৌকাযোগে জাহাজমারা চ্যানেল পার হয়ে নিঝুম দ্বীপ পৌছা যাবে। চারদিকে জলরাশির মাঝে নিঝুম দ্বীপ। যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে এই অঞ্চলের মানুষের অন্য অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ করতে হলে জোয়ার ভাটার উপর নির্ভর করতে হয়। বলা যায় মেনে চলতে হয় পুরোপুরি জোয়ার ভাটা। ঢাকায় যেতে হলে এই অঞ্চলের মানুষদের সকাল ৯ টার ( জোয়ার আসার ) পর হাতিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হয়। তারপর প্রায় ২-৩ ঘণ্টা ট্রলার ভ্রমণ শেষে হাতিয়া পৌঁছায়। তারপর পাওয়া যায় ঢাকাগামী লঞ্চ। প্রতিদিন একবেলা ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে লঞ্চটি। বরিশাল এবং ভোলা হয়ে ঢাকায় পৌঁছায় বিধায় নিঝুম দ্বীপের মানুষজন ভোলা কিংবা বরিশালে যেতে পারেন এই লঞ্চে করেই। এছাড়া হাতিয়া কিংবা ঢাকায় আসার জন্য রয়েছে বিকল্প পথ। বন্দরটিলা থেকে নদী পার হয়ে হাতিয়ায় পৌঁছাতে হয়। সেখান থেকে বিভিন্ন যানবাহন পার করে প্রথমে হাতিয়া শহরে তারপর লঞ্চে পার হয়ে মাইজদি অতঃপর ঢাকায় পৌঁছাতে হয়।
বিশ্রামের স্থান
নিঝুম দ্বীপ পর্যটকদের জন্য রয়েছে অবকাশের নিঝুম রিসোর্ট। যেখানে রয়েছে সাপ্লাই পানি এবং জেনারেটারের মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবস্থা। খাবারের জন্য রয়েছে স্থানীয় হোটেল। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত চাল, মাছ, মুরগি, ডিম, ইত্যাদিই খাবারের একমাত্র ভরসা। তবে বর্ষার মৌসুমে রয়েছে ইলিশের জয়জয়কার।
বিঃদ্রঃ
মনে রাখবেন যেখানেই ভ্রমণ করতে যাননা কেন, আপনার দ্বারা পরিবেশের কোন ক্ষতি যেন না হয়। নিঝুম দ্বীপ সম্পর্কে আপনাদের যে কোন মতামত ও পরামর্শ থাকলে পর্যটনলিপিকে জানাতে পারেন। পরবর্তী পর্বে আপনাদের সামনে বাংলাদেশের নতুন চমক নিয়ে হাজির হব, আশা করছি সাথেই থাকবেন।
কন্টেন্ট রাইটার- দেবযানী দত্ত
অসাধারণ লিখনী। আসলে না যেয়ে সবসময়ই মনে হয়ে আমি যেন নিঝুম দ্বীপে পৌছে গেছি।
ধন্যবাদ, আমাদের সাথেই থাকুন।