বানর গ্রাম নামটা শুনলেই কেমন অদ্ভুত মনে হয় না? রাজধানী ঢাকার পার্শ্ববর্তী শিল্পসমৃদ্ধ একটি জেলা শহর নরসিংদী। এই জেলার মনোহরদী উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরবর্তী নিভৃত এক পল্লী রামপুর গ্রাম। আর এই গ্রামেই প্রচুর পরিমাণে রয়েছে মনুষ্যজাতির অতীত সহচর বানর।
রামপুর যা বানর গ্রাম নামে পরিচিত
বানর গ্রাম যাওয়ার পথে রামপুর বাজারে ঢুকতেই চোখে পরবে ঘরের চালে, গাছের নীচে কিংবা গাছের উপরে দলবেঁধে বসে আছে অজস্র বানর। গ্রামটির আয়তন প্রায় ৪ বর্গকিলোমিটারের কাছাকাছি। ছয় সহস্রাধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত গ্রামটিতে বর্তমানে বানরের সংখ্যা প্রায় ৪০০০ এর মতো বলে মনে করা হয়।
মানুষ-বানরের সম্পর্ক
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের পাশাপাশি এই গ্রামে বানর বসবাস করে আসছে। অত্যন্ত দাপটের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে সর্বাধিক বানর বসবাস করে এই গ্রামের ঝোপ-জঙ্গলে। তবে সংরক্ষণের অভাবে বানরগুলো এখন ঝোপ-জঙ্গল থেকে বেরিয়ে মানুষের ফসলের ক্ষতিসাধন করে। ফলে বানরের উপদ্রবে অতিষ্ঠ গ্রামবাসী। কিন্তু এত শত অত্যচার সহ্য করেও এই প্রাণিদেরকে তারা আগলে রেখেছেন ভালোবেসে। পথচারীরা কেউ কিছু দিলেই দলবেঁধে এসে বানররা তা খেতে শুরু করে। এমনকি স্থানীয় মানুষের সঙ্গে এদের যে সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করা যায় না। স্থানীয় মানুষের হাত ধরে হাঁটতেও দেখা যায় এখানকার বানরদের। আবার কখনো তাদের হাতে সুবোধ প্রাণীর মত এরা খাবার খেতে থাকে। তবে এদের সঙ্গে দুষ্টুমি করলে কিন্তু এরা কাউকেই কোন ছাড় দেয় না। বানরের খপ্পড়ে তাকে পড়তেই হবে। মানুষে মানুষে যেমন ঝগড়া ফ্যাসাদ হয় তেমনি রামপুরের বানররাও ঝগড়া-ফ্যাসাদ করে।
বানর গ্রাম ও অত্যাচারী বানরদল
গ্রামবাসীদের ভাষ্যমতে , বানরগুলো বাগানের কাঁঠাল, লিচু, ফলমূল, আখ, কলা, শাকসবজি খেয়ে ফেলে। পান খায় না কিন্তু পানের বরজে ঢুকে শলা ভেঙে ক্ষতিসাধন করে। কেউ বানরকে মারতে গেলে জোটবদ্ধ হয়ে বানরের দল গাছের ডালপালা নিয়ে তার দিকে তেঁড়ে আসে। এমনকি ঘরে ঢুকে হামলাসহ মালামাল লুট করেও নিয়ে যায়।
এরা সাধারণত থাকে জঙ্গলে, গাছের ডালে অথবা সুযোগ বুঝে কোনো কোনো বাড়ির ঘরের চালা বা ছাদে। নিত্যদিন গ্রামজুড়ে ছোটাছুটি করে খাবার সংগ্রহ করে। মানুষের সাথে খাবার নিয়ে ঝগড়াঝাটি, কাড়াকাড়ি, লাঠালাঠি এবং ধরাধরি হতেই থাকে। হা-হুতাশ করতে করতেই সারাদিন মানুষকে ব্যস্ত থাকতে হয়। বিভিন্ন ফলগাছের কচি ফলমূল, বিশেষ করে কলা, কাঁঠাল, দোকানির বিস্কুট, বাদাম, কেক, মোয়া শিশুদের হাত থেকে খাবার ছোঁ মেরে নিয়ে দৌড় দেয়া এবং ঘরণীর পরিশ্রমে রান্না করা খাবার নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে চুরি করে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া বানরদের নিত্যদিনের ঘটনা। খাবার নিয়ে নিমিষেই তারা চলে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে। মাঝে-মধ্যে আসল মালিকের দু-চারটি আঘাত বা ঘা খেলেও তাতে তাদের কিছুই আসে-যায় বলে মনে হয় না।
বানরের খাবার চুরি
পূর্ব রামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সরস্বতী রাণী দাস একদিন তার বিদ্যালয়ে এক আত্মীয় আসবেন বলে বাড়ি থেকে টিফিনবক্স ভর্তি করে নানা রকম খাবার এনেছিলেন। টিফিনবক্সটি অফিসকক্ষে রেখে তিনি শ্রেণিপাঠদানে মগ্ন হয়ে পড়েন। পাঠদান শেষ হতে হতেই কাঙ্ক্ষিত আত্মীয় চলে আসবেন এবং তৃপ্তিসহ দুজনে বাড়ি থেকে আনা খাবার খাবেন। আত্মীয় যথাসময়ে এসেছিলেন ঠিকই, কিন্তু ততোক্ষণে একটা দুষ্টু বানর টিফিনবক্সটি নিয়ে চম্পট দেয় এবং সঙ্গী-সাথী নিয়ে মহানন্দে মধ্যাহ্নভোজ সেরে ফেলে। সরস্বতীর অতিথি এসে আপ্যায়নের পরিবর্তে পেয়েছিলো বানরদলের স্বাগত চাহনি। বিদ্যালয়ের সন্নিকটে একটি বড়ো গাছের ডালে বসে খেয়েদেয়ে হ্যাঁদারাম অভ্যর্থনাকারীর মতো অতিথিকে মুচকি হাসির ভেঁপু বাজিয়ে এদের উপস্থিতির জানান দিয়েছিলো।
রামপুরের নামকরণ ও বানরের আগমনী ইতিহাস
কথিত আছে আজ থেকে দেড়শ বছর আগে এখানকার ভূমি অফিসের এক তফশিলদার একটি পুরুষ বানর পুষতেন। বদলি হয়ে তিনি চলে গেলেও রেখে যান বানরটি। পরবর্তীতে অপর এক তফশিলদার আরেকটি স্ত্রী বানর এনে দুটিকেই জঙ্গলে ছেড়ে দেন। সেই থেকে বাড়তে থাকে বানরের সংখ্যা।
আবার অনেকের মতে, বৃটিশ আমলের শেষদিকে ধুরন্ধর বৃটিশরাই রামপুরে বানর নিয়ে এসেছিলো। সাধারণ মানুষকে বানরের ভয় দেখিয়ে নিজেদের আত্মরক্ষা এবং এদের সহযোগিতায় বেনিয়ারা টিকে থাকার কথা ভাবে। কিন্তু সে-আশা সফল হয়নি। রামপুর তথা ভারতবর্ষ ছেড়ে তারা পালিয়েছে অনেক আগেই।
তবে জনশ্রুতি রয়েছে যে, রামপুর গ্রামের নামকরণই হয়েছে রাজা দশরথপুত্র শ্রী রামচন্দ্রের নামানুসারে। হিন্দুধর্মের ত্রিমূর্তি, যার একটির প্রতীক মহাদেবতা বিষ্ণুর সপ্তম অবতার শ্রী রামচন্দ্র। মহাকাব্য রামায়ণের তিনি কেন্দ্রীয় চরিত্র। সাধারণ একজন অবতারের অনেক ঊর্ধ্বে রামচন্দ্রের স্থান। ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক স্থান, স্থাপনা, গ্রাম, নগর ও প্রতিষ্ঠান রামচন্দ্রের নামে নামকরণ করা হয়েছে। সম্ভবত রামের নাম অনুসারেই মনোহরদীর এ গ্রাম রামপুর। অতীতে বিভিন্ন স্থানে রামকে কেন্দ্র করে যে রামকেলী বা রামলীলাকীর্তন হতো, তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমান রামপুর রামের লীলার অংশবিশেষ মাত্র। আর দৈব কারণে হয়তো রামের লীলাকীর্তনের সাথী হয়ে বানরদল এখানে এসে আর ফিরে যায়নি। এখন নেই অযোধ্যাও, নেই রামরাজত্বও, নেই রামকেলীও। কিন্তু রামায়ণের সেই চেনা সুরের রেশ এখনো শেষ হয়ে যায়নি রামপুরে।
রহস্যময় বানরের দল
১৯৫.৫৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মনোহরদীতে অনেক গ্রাম থাকলেও অন্য কোনো গ্রামে রামপুরের মতো বানরের দল নেই। কোন এক অজানা কারণে রামপুরই এদের অতি প্রিয় গ্রাম সুদূর অতীতকাল থেকে। রহস্যাবৃত বিষয় হলো, আশেপাশে এতো গ্রাম থাকা সত্ত্বেও বানরদল অন্য কোনো গ্রামে মোটেও যেতে চায় না বা বসবাস করে না। গ্রামের সীমানা কখনোই ত্যাগ করে না তারা।
বানরদের দুর্দশা
বানরদের জন্যে সুনির্দিষ্ট বেষ্টনী বা স্থান না থাকায় এরা ঘুরে বেড়ায় গ্রামের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে। কখনও কখনও চলে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে, উঁচু বৃক্ষের ডালে বা নিরিবিলি জঙ্গলে। এরা সারাদিন বাঁদরামি করে খাবার সংগ্রহ করে। খাবার না পেয়ে পেয়ে এবং জীবনযুদ্ধে হেরে গিয়ে অনেক বানরকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেও দেখা যায়। এদের এই করুণ পরিণতি দেখে এদেরই দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামবাসীরা কেউ কেউ পাশে এসে দাঁড়াতে আরম্ভ করেছে। মানুষের মায়াবী দৃষ্টিতে করুণ দৃশ্য ফুটে ওঠে প্রতিনিয়ত। স্থায়ী কোনো ঘর বা শেড না থাকলেও প্রতিদিন দূর-দূরান্তের মানুষ রামপুরে বানর দেখতে আসেন।
বানরের বাঁদরামো
স্থানীয় সিদ্ধেশ্বরী মন্দির মাঠে বানর দল মনের আনন্দে দিনভর খেলা করে। বানরের মিলন মেলা দেখতে প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা ভিড় জমায় রামপুর গ্রামে। কেউ মুড়ি, কেক, বিস্কুট, কলাসহ বিভিন্ন খাবার দিলে বানরের দল ভেংচি কেটে তাদেরকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে। আবার অল্প সময়ের মধ্যে দশনার্থীদের সঙ্গে বানরগুলোর বন্ধুত্ব হয়ে যায়। পরে দর্শনার্থীদের ছুঁড়ে দেয়া খাবার এরা গ্রহণ করে। তবে বানরদের মধ্যে গোলমাল বাঁধলে তা ঠেকানো দায়। আবার তাদের মধ্যে গ্রুপিংও আছে। বানরদের একটি দলকে খেতে দিলে অন্য দলের বানর এই খাবার খেতে আসেনা। এক দলের বানরকে অন্য দলের বানর অপমান করলে তারা শোধ নিতে দল বেঁধে বেড়িয়ে পড়ে। এত সব কিছুর পরও রামপুরের বানরের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক দেখলে অবাক হতে হয়।
যেভাবে যাবেন বানর গ্রাম
ঢাকা হতে নরসিংদী ও মনোহরদী হয়ে মঠখোলা রোডের যেকোনো সড়ক পরিবহনে মনোহরদীর সাগরদী বা শরীফপুর নেমে সিএনজি বা রিকশায় চড়ে ১০ মিনিটেই রামপুর পৌঁছানো যায়। বলা যায়, রামপুর একটি মিনি পর্যটন স্থান।
Add comment