নরসিংদীর ধাঁধার চর নামক জায়গাটি হয়তো অনেকের কাছেই এখনো অজানা। পৃথিবীর মানচিত্রে নদীমাতৃক দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ। নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে এখানকার মানুষের সভ্যতা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যবাহী বাজার, গ্রাম, গঞ্জ ও শহর।
নরসিংদীর নয়নাভিরাম ধাঁধার চর
বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্রায় সহস্রাধিক ছোট-বড় নদ-নদী-উপনদী-শাখানদী। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার জন্য ভ্রমণ করা যেতে পারে নরসিংদীর ধাঁধার চর থেকে যা বর্ষাকালে সমুদ্র সৈকত নামে পরিচিত।
অবস্থান
কথিত আছে, বাংলাদেশকে প্রায় আড়াই প্যাঁচে আবৃত করে আছে ব্রহ্মপুত্র নদ। বাংলাদেশের দীর্ঘতম এই ব্রহ্মপুত্র নদের একটি শাখা নদী হলো শীতলক্ষ্যা। গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার সাত-আট কিলোমিটার পূর্ব দিয়ে দক্ষিণমুখী হয়ে কাপাসিয়া উপজেলা শহরের মধ্য দিয়ে কালীগঞ্জ, রূপগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ হয়ে নারায়ণগঞ্জ সদরে ধলেশ্বরী নদীতে মিলিত হয়েছে ১১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ শীতলক্ষ্যা। এ নদীর খ্যাতি পরিষ্কার ও স্বচ্ছ পানির জন্য। আর এ নদীর বুকেই জেগে উঠেছে নৌকা আকৃতির এক বিশাল চর। নাম তার ধাঁধার চর।
পূর্ব গল্প
জানা গেছে, চরের সূচনালগ্নে এর মালিকানা নিয়ে ভাওয়ালের রাজা ও বার ভূঁইয়াদের এক ভূঁইয়া মহেষ উদ্দীনের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। বিরোধ মেটাতে এগিয়ে এলেন স্থানীয় মাতব্বররা। তারা একটি কলসি নদীতে ভাসিয়ে দিলেন। বললেন, কলসিটি নদীর যে পাড়ে গিয়ে ভিড়বে চরের দখল পাবেন সেই পাড়ের লোকজন। কলসিটি নদীর পশ্চিম পাড়ে অর্থাৎ ভাওয়াল রাজার এলাকায় (বর্তমানে গাজীপুরের কাপাসিয়া) এসে ভিড়ে। তারপর থেকেই ধাঁধার চরটি পশ্চিমপাড়ের ভাওয়াল রাজা পরগনার (বর্তমানে গাজীপুরের কাপাসিয়া) দখলে। হিন্দু কৃষকরা ভাওয়ালের রাজাকে খাজনা দিয়ে চাষাবাদ শুরু করেন। ১৮১৬-১৮১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার চরের জরিপ করে কৃষকদের বৈধ মালিকানা দেয়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর সনাতন ধর্মাবলম্বীরা চরের জমি বিক্রি করে ভারতে পাড়ি জমান। এখন পুরো চরের মালিকানা মুসলিম কৃষকদের হাতে।
সৌন্দর্য পরিক্রমা
আড়াইশ বছর আগে গাজীপুর ও নরসিংদীর সীমানাবেষ্টিত শীতলক্ষ্যা ও ব্রহ্মপুত্র নদের তারাগঞ্জ, রাণীগঞ্জ, লাখপুর, চরসিন্দুর এলাকায় নদীর মাঝখানে জেগে ওঠা ২৫০ একর আয়তনের এ চরকে অনেকে বলে মাইঝ্যার চর বা মাঝের চর। কারণ চারটি গ্রামের মাঝখানে এর অবস্থান। দূর থেকে দেখলে এ চরটিকে অনেকটা সেন্ট মার্টিনসের মতো মনে হয়। আবার পুরো ভিউটা একসঙ্গে দেখলে মনে হয় টাইটানিক জাহাজ।
এক সময় এই চরের নাম-নিশানা ছিল না। ছিল বহমান নদী। ব্রহ্মপুত্র নদ ও শীতলক্ষ্যা নদীর সঙ্গমস্থলে বিন্দু বিন্দু বালুকণা জমতে জমতে বেলে মাটিতে পূর্ণ হয়ে এক সময় যখন চর জেগে ওঠে, তখন স্থানীয় লোকজন এটি দেখে ধাঁধায় পড়ে যান। সেই থেকে এর নাম ধাঁধার চর। সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা সবুজে ঘেরা ধাঁধার চর দৈর্ঘ্যে সাড়ে ৪ কিলোমিটার। বর্ষাকালে নদীর বিশাল ঢেউ দেখলে মনে হয়- এ যেন আরেক কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। বর্ষাকালে শুধু এই ঢেউ দেখতে বিভিন্ন এলাকা থেকে ছুটে আসেন পর্যটকরা।
ধাঁধার চর বলার কারণ
ধাঁধার চরের অবস্থানটাও বেশ ধাঁধা লাগানো। চরের উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম চারদিকেই শীতলক্ষ্যা নদী, উত্তর-পূর্ব কোনায় ব্রহ্মপুত্র নদ। চরের পূর্ব পাশে শিবপুর-মনোহরদী ও পশ্চিম পাশে কাপাসিয়া-কালিগঞ্জ উপজেলা। দুই পাশে দুই জেলা গাজীপুর ও নরসিংদী। বর্ষা মৌসুমে দুইটি নদীই থাকে গর্ভবতী, জলে টইটম্বুর। শীতকালে এটি হয়ে ওঠে আরও মনোলোভা। এই চরে রয়েছে বড় বড় পেয়ারার বাগান, আমগাছ, কাঁঠাল গাছ, কলাবাগান ও বিভিন্ন জাতের ফসলি ক্ষেত। পাখির কিচির-মিচির শুনে ইচ্ছা হবে পাখি হয়ে গান গেয়ে গেয়ে উড়ে যাই চরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। চরের ডান পাশের নদীতে ও তীরে দেখা মেলে নাম জানা না জানা প্রায় ১০ প্রজাতির অতিথি পাখির। আর চরের ভিতরে গাছ-গাছালিতে বিভিন্ন ধরনের দেশি পাখি তো আছেই। তবে ঘুঘু পাখির প্রাচুর্য চোখে পড়ার মতো। তাছাড়া চরে দেখা যায় গোসাপ ও কাঠবিড়ালী।
বিকেলের সৌন্দর্য ও প্রাকৃতিক লীলা
বিকালের চরটি বড়ই মনোরম। ঝিরঝিরে বাতাস। উড়ন্ত পাখির কলকাকলি। মাঝির আকুল করা গান। চরের বুক দিয়ে হাঁটলে কল্পনা করা যাবে না এটি একটি চর- যার দুইপাশে রাক্ষুসে দুই নদী। মনে হবে মাসি-পিসির ঘুম পাড়ানো শান্ত-স্নিগ্ধ একটি গ্রাম। সত্যিকার অর্থেই এটি দেখার মতো একটা জায়গা। এখানকার নৌকা দিয়ে চরের চারপাশ ভ্রমণ, চরে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে পেয়ারা বাগান, কলা বাগান, সারি সারি তাল গাছ, জাম গাছ, কুল বাগান ও নানা প্রজাতির অসংখ্য ঔষধি গাছ দেখতে পাবেন। পাশেই নদীতে থৈ থৈ জলরাশি। ওপরে দিগন্ত বিস্তৃত খোলা আকাশ। মাছরাঙা পাখির হুটহাট জলচুম্বন, পানকৌড়ির লুকোচুরি। ভাগ্য ভালো থাকলে দেখতে পাবেন ঘোমটা দেওয়া শুশুক বা গাঙ্গেয় ডলফিন। জলের সাদা ফেনা থেকে আছাড় খাচ্ছে প্রায় আড়াইশ একর জমি নিয়ে গভীর জলের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ধাঁধার চরের বুকে।
পুণ্যস্নানের গল্প
চরটির পূর্ব দিকে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে বটতলায় আছে ঐতিহাসিক ঘিঘাট। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন অষ্টমী তিথিতে এ ঘাটে পুণ্যস্নান করেন। এটি চলে আসছে সেই ভাওয়াল রাজার আমল থেকে এবং তা এখনো চলছে।
শুটিং স্পট
এ চরটিকে শুটিং স্পট হিসেবেও ব্যবহার করা হয়েছে বহুবার। শাবনাজ-নাঈম অভিনীতি বিষের বাঁশি চলচ্চিত্রটির অধিকাংশ দৃশ্য এখানেই ধারণ করা হয়। এ চরটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবে।
মাটির গল্প
এই চরের মাটি খুবই উর্বর। রোপণ করলে হয় না, এমন কোনো ফল-ফসল নেই। এক সময় চরে প্রচুর আখ হতো। এখন সবচেয়ে বেশি সবজি চাষাবাদ হয়। মাটি অতি ফলনশীল। সারবিহীন ফসল সুস্বাদু। ১৯৬০, ১৯৮৮, ১৯৯৮ সালের বন্যায় এ চরটি তলিয়ে গিয়েছিল। ১৯৬০ সালের বন্যার পর চরে কোমর পর্যন্ত পানি জমে যায়। ফলে মাটির উর্বরাশক্তি আরও বাড়তে থাকে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন
২০০৬ সালের সার্ক সম্মেলনে ধাঁধার চরটিকে গ্রামীণ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তা আর বাস্তবায়িত হয়নি। তবে প্রকৃতির ভ্রমণপিয়াসী মানুষের কাছে ধাঁধার চর হয়ে উঠেছে অনেকটা সাচ্ছন্দময়। শীত এবং বর্ষা মৌসুম ছাড়াও ঈদে চরে বিপুল লোক সমাগম ঘটে। ভ্রমণপিপাসুরা দূরদূরান্ত থেকে জন্মদিন, পিকনিকসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আনন্দ উপভোগ করতে চলে আসেন ধাঁধার চরে। পর্যটকদের জন্য চরে বিশুদ্ধ নলকূপের পানি, টয়লেট, রান্না ও বিশ্রামের ব্যবস্থা রয়েছে।
কিভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে ধাঁধার চর যাবার সবচেয়ে সহজ রুট হলো ঢাকার গুলিস্তান বা ফার্মগেট থেকে কাপাসিয়া আসবেন। সময় লাগবে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। ভাড়া লাগবে মাত্র ১০০-১৭০ টাকা। এখান থেকে বাস বা সিএনজিতে সোজা রানীগঞ্জ চলে এলেই দেখা যাবে দুই নদীর বুকে ভাসছে অদ্ভুত ধাঁধা লাগানো চর ধাঁধার চর। তাছাড়া রেলপথে জয়দেবপুর স্টেশনে নেমে, জয়দেবপুর থেকে সিএনজি করে রানীগঞ্জ যাওয়া যায়। এমনকি কাঞ্চন ব্রিজ থেকে বোট রিজার্ভ করে চলে যেতে পারেন ওই চরে। ভাড়া আনুমানিক ৭০০০ টাকা আসা-যাওয়া।
কন্টেন্ট রাইটার- ফাহিম সাদেক সৌরভ
[…] চাপে পিষ্ট হয়ে আমাদের চারপাশের সবুজ প্রকৃতিও আজ হারিয়ে গিয়েছে ইট-পাথরের ধূসর […]