নওগাঁ জেলার ইতিহাস ও দর্শনীয় স্থান নিয়ে বলতে গেলে বলতে হয় যে নওগাঁ জেলা ঐতিহাসিক গুরুত্বের দিক দিয়ে অত্যন্ত সমৃদ্ধ।
ইতিহাস ঐতিহ্য ও নওগাঁ জেলার দর্শনীয় স্থান
এশিয়ার বৃহত্তম বৌদ্ধ বিহার, পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, হলুদ বিহার, ধামইরহাট উপজেলায় অবসিহত ভীমের পান্টি, মাহিসন্তোষ, আলতাদীঘি ও জগদলবাড়ি, আগ্রাদ্বিগুন পুরাকীর্তির ধ্বংসাবশেষ, পত্মীতলা উপজেলায় অবসিহত দিব্যক জয়স্তম্ভ, নওগাঁত সদর উপজেলায় দুবলহাটি জমিদার বাড়ি ও বলিহার রাজবাড়ি এবং আত্রাই উপজেলায় অবসিহত বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত পতিসর কুঠিবাড়ি এসব নিয়েই নওগাঁ জেলা। আজ আমরা এক নজরে নওগাঁ জেলার দর্শনীয় স্থান সমূহ তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
কুসুম্বা মসজিদ
কুসুম্বা মসজিদ আত্রাই নদীর দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে এবং মান্দা উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার দুরে রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের পশ্চিমে অবস্থিত। বরেন্দ্র জনপদের নওগাঁ জেলার বৃহত্তম উপজেলা মান্দায় অবস্থিত ঐতিহাসিক কুশুম্বা মসজিদ সুলতানী আমলের একটি উজ্জ্বল নিদর্শন। এর মিহরাবের উপরে সুলতান আলা-উদ-দীন হোসাইন শাহ এর নাম লিপিবদ্ধ থাকায় ধারনা করা হয় তাঁর শাসনামলে মসজিদটি নির্মিত হয়।
কুসুম্বা মসজিদের কাঠামো
মসজিদটি চতুস্কোণ বিশিষ্ট কালো ও ধুসর বর্ণের পাথর এবং পোড়া মাটির ইষ্টক দ্বারা নির্মিত। জ্যামিতিক নক্সার আদলে পোড়ামাটির সুদৃশ্য কারুকাজ খচিত মাটির টালি, মিহরাবে বিভিন্ন ফুল, লতা-পাতা ঝুলন্ত শিকল ও মনোরম শৈল্পিক কারুকাজ যা মুসলিম স্থাপত্য কলার অপূর্ব সমাহার। ইটের তৈরী এই মসজিদের দেওয়াল গুলো বাইরে ও ভিতরে পাথর দ্বারা আবৃত। মসজিদের চার কোনে ৪ টি অষ্টকোনাকার বুরুজ বা টারেট আছে। মসজিদের অভ্যন্তরে দুটি প্রসস্থ স্তম্ভ আছে। এই দুটি স্তম্ভ ও চার পাশের দেয়ালের উপর মসজিদের ৬ টি গম্বুজ আছে। মসজিদটির সম্মূখে ২৫.৮৩ একের আয়তনের একটি বিশাল জলাশয় রয়েছে। মসজিদের অভ্যন্তরে উত্তর-পশ্চিম কোনে স্তম্ভের উপর একটি উচু আসন রয়েছে। এই আসনে বসেই কাজী/বিচারক বিচার কার্য পরিচালনা করতেন বলে ধারনা করা হয়।
কুসুম্বা মসজিদে যাতায়াত
রাজশাহী মহাসড়কে বাসযোগে ৪০ মিনিট সময় লাগবে।
পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার
পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বা সোমপুর বিহার: বদলগাছী উপজেলা তথা নওগাঁ জেলার সর্বাপেক্ষা গৌরবময় দর্শনীয় স্থান হলো সোমপুর বিহার বা পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার। বর্তমান পাহাড়পুর ইউনিয়ন পরিষদের অর্ন্তগত পাহাড়পুর গ্রামে পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার অবস্থিত। পাহাড়পুর নামটি আধুনিক এর প্রাচীন নাম সোমপুর। বাংলাদেশে সপ্তম শতাব্দিতে (৭৭০-৮১০ খ্রি:) বৌদ্ধ ধর্মীয় পাল রাজ বংশের প্রতিষ্ঠা হয়। খ্রীষ্টিয় অষ্টম ও নবম শতাব্দিতে পাল বংশের দ্বিতীয় ও তৃতীয় রাজা ধর্মপাল ও তার পুত্র দেবপাল বাংলা, বিহার এবং কনৌজ পর্যন্ত বিরাট সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। বৌদ্ধ ধর্মের চরম উৎকর্ষতার যুগে তাদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশে এই পাহাড়পুর বিহার ও মন্দির গড়ে ওঠে। ঐতিহাসিক ও ভৌগলিক কারণে এই মহাবিহারটি ধ্বংসস্তুপে পরিনত হলেও আজও এই অপূর্ব বিহারটি এশিয়ার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বৌদ্ধ বিহার বলে সগৌরবে দন্ডায়মান।
পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের কাঠামো
পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য ১৭৭ টি কক্ষ ছিল। মোট ৭০.৩১ একর জমির উপর পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার অবস্থিত। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এখানে একটি যাদুঘর, একটি রেষ্ট হাউজ ও কয়েকটি প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ করেছে। ১৯৩৪ খ্রি: পর্যন্ত খননের ফলে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এই বিহারের পূর্ব দিকে সত্যপিরের ভিটা ও মন্দিরের চর্তুদিক বেষ্টীত কক্ষগুলো ও সমগ্র প্রত্নাবশেষটি আবিস্কার করেন। এর মধ্যভাগে প্রধান বিহার এবং তাকে ঘিরে ১৯৮টি বাসপযোগি কক্ষ, বিস্তৃত প্রবেশ পথ, অসংখ্য বিনোদনস্তুপ, ছোট ছোট মন্দির, পুষ্করিণী অবস্থিত। মন্দিরটি উত্তর-দক্ষিণে দৈঘ্য ৩৫৭ ফুট প্রস্থে পূর্ব-পশ্চিমে ৩১৪ ফুট। মূল বিহারটি এর মধ্যস্থলে অবস্থিত। সন্ধ্যাবর্তী এখানকার রাজার কণ্যা ছিলেন। আকর্ষনীয় স্থাপত্য বিশাল আয়তন ও ঐতিহাসিক গুরুত্বের জন্য পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার আজ বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন সংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃত। সম্প্রতি এটি ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা ভূক্ত হয়েছে।ঐ পাহাড়পুরের প্রস্তর গ্রাত্রে ৬৩টি মুর্তি দেখা যায়। মন্দির গ্রাত্রেও বহু জীব-জন্তুর মুর্তি পাওয়া যায়। মূল ভূমি থেকে বিহারটির উচু প্রায় ৭২ ফুট। পাহাড়পুরকে প্রাচীন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিনি সংস্করণ হিসেবে চিহিত করা যায়।
পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের যাতায়াত
নওগাঁ বালুডাংগা বাস টার্মিনাল হতে সরাসরি বাসযোগে ঐতিহাসিক পাহাড়পুরে যাওয়া যায় যার আনুমানিক দূরত্ব আনুমানিক ৩২ কিঃমিঃ।
বলিহার রাজবাড়ী
নওগাঁ জেলার দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে বলিহার রাজবাড়ী অন্যতম। নওগাঁর পুরাতন জমিদারের মধ্যে যারা মুসলিম পর্বে জায়গীর লাভ করেছিল বলিহারের জমিদার তাদের মধ্যে একজন। কথিত আছে যে, সম্রাট আওরঙ্গজেবের এক সনদ বলে বলিহারের এক জমিদার জায়গীর লাভ করেন। বলিহারের নয় চাকার রথ প্রসিদ্ধ ছিল। বলিহারের জমিদারদের মধ্যে অনেকেই উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন। রাজা কৃষ্ণেন্দ্রনাথ রায় একজন লেখক ছিলেন।
বলিহার রাজবাড়ীর কাঠামো
বলিহারের জমিদার রাজেন্দ্র ১৮২৩ খিস্টাব্দে লোকান্তরিত হবার পূর্বে এখানকার বিখ্যাত দূর্গামন্দিরে রাজ রাজেশ্বরী দেবীর অপরূপা পিতলের মুর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মন্দির ভবনের ভিতরে অনেক কক্ষ। এই কক্ষগুলিও এক একটি মন্দির ছিল বলে জানা যায়। বলিহার রাজবাড়ির সম্মুখের কারুকার্যময় অলংকরণ বিশিষ্ট মন্দির ও বিশাল দ্বিতল রাজবাড়ির অংশ দর্শকদের নিকট আজও আকর্ষণীয়।
পতিসর কাচারীবাড়ি
কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের বাংলাদেশে শিলাইদহ, শাহাজাদপুর ও কালিগ্রাম পরগনাসহ মোট তিনটি জমিদারি ছিল। ভাগবাটোয়ারা সূত্রে রবীন্দ্রনাথের ভাগে পড়ে কালিগ্রাম পরগনা। গোলাম মুরশিদের মতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারির দায়িত্ব নিয়ে পতিসর আসেন ১৮৯০ সালের ডিসেম্বর মাসে। আহমদ রফিকের মতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯১ সালের ১৩ জানুয়ারী শাহাজাদপুর হতে পতিসর অভিমুখে রওনা হয়ে সম্ভবত ১৬ জানুয়ারী পতিসর পৌঁছান। পতিসর থেকে স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে পত্রে লেখেন-‘‘আজ আমি কালীগ্রামে এসে পৌঁছালুম, তিন দিন সময় লাগল।’’ কালিগ্রাম স্টেটের কাচারীবাড়ী ছিল পতিসরে ।
কাচারীবাড়ীটি নাগর নদীর তীরে অবস্থিত। কাচারীবাড়ীটি নির্মাণের পর ১৯৯১ সালে সংস্কার করা হয়। এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজরিত অনেক নিদর্শন রয়েছে। কাচারী বাড়ীটির পাশেই রয়েছে দেবেন্দ্র মঞ্চ ও রবীন্দ্র সরোবর। এখানে প্রতি বছরের ২৫শে বৈশাখ রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী পালন করা হয়। পতিসর সম্পর্কে তিনি লেখেন-বাংলাদেশের আর পাঁচটা গ্রামের মতই পতিসর ছোটোখাটো একটি গ্রাম, স্থানীয় লোকজনের ভাষায় অবশ্য গন্ডগ্রাম। পতিসর-কালীগ্রাম পরগনার জমিদারির সদর কাছারি এই গ্রামে বলেই এর গুরুত্ব ভিন্ন। এখানে এসে তিনি বৃহৎ গ্রামময় পল্লী বাংলা মানুষের দুঃভরা মুখ দেখতে পেয়েছিলেন। ‘স্বর্গ হইতে বিদায়’ নিয়ে মানুষের কাছে তাঁর অবস্থান নির্ধারণ করে কবি ধূলিধূসরিত মাটির পৃথিবীতে, তাঁর ভাষায় ‘সংসারের তীরে’ নেমে আসেন। তিনি অনুন্নত পরগনার রাস্তাঘাট নির্মাণ, কূপ, দীঘি, পুকুর খনন, জঙ্গল পরিষ্কার, গ্রাম্য সালিসী ব্যবস্থা ও মহাজনদের সুদের হাত হতে দরিদ্র প্রজাদের রক্ষা করেন।
রবীন্দ্রনাথ পরগণার উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষার দিকে বেশি গুরুত্ব দেন। এ মানুষগুলোর শিক্ষার জন্য তিনি গ্রামে গ্রামে অবৈতনিক শিক্ষা চালু করেন। কালীগ্রাম পরগনার প্রজাদের শিক্ষায় আলোকিত করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে তিনটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নোবেল পুরস্কারের সমুদয় অর্থ কালীগ্রাম পরগনার উন্নয়নে কাজে লাগান। পতিসরে তিনি কালীগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউট স্থাপন করেন। ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত অসংখ্য কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস ও চিঠিপত্র লিখেছেন।
জগদ্দল বিহার
জেলা শহর থেকে ৫৪ কিঃমিঃ দূরে ধামইরহাট উপজেলায় জগদ্দল বিহার অবস্থিত। এটি একটি প্রাচীন কীর্তি। বর্তমানে স্থানীয় জনগণ এটাকে বটকৃষ্ণ রায় নামক একজন জমিদারের বাড়ীর ধ্বংসাবশেষ বলে মনে করে।
[…] বৃহত্তর রাজশাহী’র অন্তর্গত নওগাঁ জেলায় এই মহাবিহারের বিশালাকার […]