মসলিন কাপড় ছোট একটা আংটির ভেতর থেকে সহজেই চলে যেতে পারতো এ কথা তো আমাদের অনেকেরই জানা। আর সেই বিস্ময়কর ব্যাপার নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
বিলুপ্ত প্রায় ঢাকাই মসলিন কাপড় এর গল্প
তুলার আঁশ থেকে সুতা তৈরি হয় আর তা দিয়ে বয়ন করা এক প্রকারের অতি সূক্ষ্ম কাপড়বিশেষ যার নাম মসলিন। ফুটি কার্পাস নামক তুলা থেকে এক প্রকার চিকন সুতা দিয়ে মসলিন তৈরি করা হত এবং এটি ঢাকাই মসলিন নামেও পরিচিত । রাজকীয় পোশাক নির্মাণে ব্যবহার করা হত এই মসলিন । মসলিন প্রায় ২৮ রকম হত যার মধ্যে জামদানী এখনও ব্যাপক আকারে প্রচলিত। নানা কারণে আঠারো শতকের শেষের দিকে বাংলায় মসলিন কাপড়ের বুনন বন্ধ হয়ে যায়।
মসলিন কাপড় নামকরণের গল্প
এস. সি. বার্নেল ও হেনরি ইউল নামের দুজন ইংরেজ কর্তৃক প্রকাশিত অভিধান ‘হবসন জবসন‘-এ উল্লেখ করা হয়েছে মসলিন শব্দটি এসেছে ‘মসুল’ থেকে। এই মসুলেও অতি সূক্ষ্ম কাপড় প্রস্তুত হত। মসলিন শব্দটি আরবি, ফার্সি কিংবা সংস্কৃতমূল শব্দ নয়।
মসলিন কাপড়ের পূর্ব গল্প
চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলায় আগত মরক্কো দেশের পর্যটক ইবনে বতুতা তার কিতাবুর রেহালা সোনারগাঁওয়ে তৈরি সুতি বস্ত্রের বিশেষ প্রশংসা করেন। পঞ্চদশ শতকে বাংলাদেশে আসা চীনা লেখকরা ও এখানকার সুতি বস্ত্রের ভুয়সী প্রশংসা করেন। মোগল সম্রাট আকবরের সভাসদ আবুল ফজল’ পর্যন্ত সোনারগাঁওয়ে প্রস্তুতকৃত এই সুক্ষ্ম সুতি বস্ত্রের প্রশংসা করতে ভোলেননি। এভাবে সপ্তদশ শতকের প্রথম দিকে ঢাকাকে বাংলার রাজধানী ঘোষণার পর হতেই ইউরোপিয় ব্যবসায়ীরা বাংলায় আসা শুরু করেন। এসকল বণিক কোম্পানি গুলোর তৎকালীন দলিল-দস্তাবেজ এবং ঐ সমকালীন ইউরোপীয় লেখকদের বিবরণে মসলিন সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়।
১৬১০ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় ইসলাম খান চিশতী রাজমহল থেকে ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তর করলে ঢাকা ইতিহাসের প্রসিদ্ধতা লাভ করে। কিন্তু ঢাকার ইতিহাস বেশি পুরনো না হলেও মসলিনের ইতিহাস অনেকটাই পুরনো ও দীর্ঘ। স্মরণাতীত বাংলায় এর উল্লেখ পাওয়া যায়।জেমস টেইলরের রচনা অবলম্বনে ইতিহাসবিদ আব্দুল করিম তার ‘ঢাকাই মসলিন’ গ্রন্থে উদ্বৃতি পেশ করেন। এছাড়াও তিনি উল্লেখ করেন যে, সমসাময়িক লেখকদের (যেমন, জেমস টেলর, বোল্ট, জন টেলর প্রমূখ) বিবরণের অভাবে প্রকৃতপক্ষে মোগল আমলে মসলিন কত সুক্ষ্ম ও মিহি ছিল তার কোন সঠিক ও অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায় না।
রকমারি মসলিন কাপড়
মসলিনের পার্থক্য করা হত সূক্ষ্মতা, বুনন শৈলী ও নকশার পার্থক্যে।
- মলবুস খাস
আঠারো শতকের শেষদিকে মলবুস খাসের মতো আরেক ধরণের উঁচুমানের মসলিন তৈরি হতো, যার নাম ‘মলমল খাস’। এগুলো লম্বায় ১০ গজ, প্রস্থে ১ গজ, আর ওজন হত ৬-৭ তোলা। ছোট্ট একটা আংটির মধ্যে দিয়ে এ কাপড় নাড়াচাড়া করা যেত। এগুলো সাধারণত রপ্তানি করা হত।
- সরকার ই আলা
বাংলার নবাব বা সুবাদারদের জন্য তৈরি হত এই মসলিন। সরকার-ই-আলা নামের জায়গা থেকে পাওয়া খাজনা দিয়ে এর দাম শোধ করা হত বলে এর এরকম নামকরণ। লম্বায় হত ১০ গজ, চওড়ায় ১ গজ আর ওজন হত প্রায় ১০ তোলা।
- ঝুনা
ঝুনা মসলিনও সূক্ষ্ম সুতা দিয়ে তৈরি হ্ত, তবে সুতার পরিমাণ থাকত কম। তাই এ জাতীয় মসলিন হালকা জালের মতো হত দেখতে। একেক টুকরা ঝুনা মসলিন লম্বায় ২০ গজ, প্রস্থে ১ গজ হত। ওজন হত মাত্র ২০ তোলা। এই মসলিন বিদেশে রপ্তানি করা হত না, পাঠানো হতো মুঘল রাজ দরবারে।
- শবনম
ভোরে শবনম মসলিন শিশিরভেজা ঘাসে শুকোতে দেয়া হলে শবনম দেখাই যেত না, এতটাই মিহি আর সূক্ষ্ম ছিল এই মসলিন। ২০ গজ লম্বা আর ১ গজ প্রস্থের শবনমের ওজন হত ২০ থেকে ২২ তোলা।
- ডোরিয়া
ডোরা কাটা মসলিন ‘ডোরিয়া’ বলে পরিচিত ছিল। লম্বায় ১০-১২ গজ আর চওড়ায় ১ গজ হত। শিশুদের জামা তৈরি করে দেয়া হত ডোরিয়া দিয়ে।
- জামদানি
মসলিনের উপর নকশা করে জামদানি কাপড় তৈরি করা হয়। জামদানি বলতে সাধারণত শাড়িকেই বোঝানো হয়। তবে জামদানি দিয়ে নকশি ওড়না, কুর্তা, পাগড়ি, রুমাল, পর্দা প্রভৃতি তৈরি করা হত। ১৭০০ শতাব্দীতে জামদানি দিয়ে নকশাওয়ালা শেরওয়ানির প্রচলন ছিল। এ ছাড়া, মুঘল নেপালের আঞ্চলিক পোশাক রাঙ্গার জন্যও জামদানি কাপড় ব্যবহৃত হত। প্রাচীনকালের মিহি মসলিন কাপড়ের উত্তরাধিকারী হিসেবে জামদানি শাড়ি বাঙালি নারীদের অতি পরিচিত।
বর্তমানে মসলিন
ঢাকা জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত মসলিন খানির দৈর্ঘ্যও ১০ গজ এবং চওড়া ১ গজ, এর ওজন মাত্র ৭ তোলা। তাহলে এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে ঢাকার মসলিন মুঘল শিল্পের স্বর্ণযুগে আরো সুক্ষ্মভাবে তৈরি করা যেতো।
[…] খুব পছন্দের একটি শাড়ি। সুতোর কাজ করা মসলিন কাপড়ের উপর আলাদা লুক এনে দেয় এই শাড়ি গুলি। […]