Porjotonlipi

মুক্তিযুদ্ধের প্রতিচ্ছবি, জাতীয় স্মৃতিসৌধ

জাতীয় স্মৃতিসৌধ ঢাকার অদূরে সাভারের নবী নগরে আমাদের অবস্থিত। লক্ষ লক্ষ শহীদ যারা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে তাদের প্রতীক হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এই স্মৃতিসৌধ বাংলার বুকে। এটি ইট, পাথরের তৈরি হলেও এটি প্রতীক অর্থে রক্তের তৈরি। এর জন্য এর রং লাল। জাতীয় স্মৃতিসৌধের অপর নাম ‘সম্মিলিত প্রয়াস’।

জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও তাঁর ইতিহাস 

স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ হয় তিন পর্যায়ে। জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতির নাম সৈয়দ মাইনুল হোসেন।  কারো মতে, প্রথম পর্বের কাজ ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয়ে শেষ হয় ১৯৭৪ সালের জুন মাসে। সে সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৬ লাখ টাকা। ১৯৭৫ সালে জানুয়ারিতে দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হয়। শেষ হয় ১৯৮২ সালের জুন মাসে। মোট ব্যয় ৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। তৃতীয় পর্যায়ে কাজ শুরু হয় ১৯৮২ সালের ২৪ আগস্ট, সমাপ্তি নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৯৮৬-এর জুন মাস পর্যন্ত। তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫ কোটি ৮১ লাখ টাকা। কিন্তু তৎকালীন সরকারের তাড়াহুড়োর কারণে ১৯৮২ সালের শেষের দিকে সৌধটির কাজ শেষ হয়।

প্রথম পর্যায়ের কাজ শুরু হয় ১৯৭২ সালে। সেসময় ২৬ লাখ টাকা খরচ করে ভূমি অধিগ্রহণ ও সড়ক নির্মাণের কাজ করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৯৭৪ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত কাজ চলে। এ সময় ৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা খরচ করে গণকবরের এলাকা, হেলিপ্যাড, গাড়ি পার্কিংয়ের স্থান, চত্বর ইত্যাদি নির্মাণ করা হয়। ১৯৮২ সালের আগস্ট মাসে শুরু হয় মূল স্মৃতিসৌধ নির্মাণকাজ। ৮ কোটি ৪৮ লাখ ৬৫ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় স্মৃতিসৌধ। এরপর এখানে তৈরি হয় কৃত্রিম লেক, সবুজ বেষ্টনী, ক্যাফেটেরিয়া, রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আবাসিক এলাকা ইত্যাদি।

গৌরবময় এ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করতে সিমেন্ট লেগেছে ১ হাজার ৪০০ টন। লোহা ৪৮০ টন। পাথর ১ লাখ ঘনফুট। বালি ৫০ হাজার ঘনফুট এবং কংক্রিটের পরিমাণ ১ লাখ ২৫ হাজার ঘনফুট। যারা কাজ করেছেন তাদের মোট শ্রমঘণ্টা লেগেছে ১১,৮৮,০০০ ঘণ্টা।

জাতীয় স্মৃতিসৌধের তাৎপর্য 

স্মৃতিসৌধ এমনই একটি স্মৃতিস্তম্ভ যা কোনো যুদ্ধে জয়ের প্রতীক হিসেবে বা যুদ্ধে হতাহতদের স্মরণ করার জন্য নির্মিত হয়। যুক্তরাজ্যের ওয়ার মেমোরিয়াল ট্রাস্ট মনে করে- ‘বাইবেলসহ বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ ও পুরাণে স্মৃতিস্তম্ভ বা এ ধরনের স্মারক নির্মাণের কথা উল্লেখ আছে। ঐতিহাসিক ঘটনা ও ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে ভবিষ্যতের মানুষদের জানানো এবং তাদের স্মরণ করার উপায় হিসেবেই স্মৃতিফলকের ধারণা এসেছে।’

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস একই সঙ্গে ত্যাগ এবং বিজয়ের সুতোয় গাঁথা। দেড়শ ফুট বা ৪৫ মিটার উঁচু এই স্মৃতিসৌধে রয়েছে ৭টি ফলক। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ৭ টি পর্যায়কে চিহ্নিত করা হয়েছে। ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬ শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ১৯৬২ শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯’র গণ-অভ্যূত্থান এবং সর্বশেষ ১৯৭১’র মুক্তিযুদ্ধ- এই সাতটি ঘটনাকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিক্রমা হিসেবে বিবেচনা করে সৌধটি নির্মিত হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধকে সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ বিবেচনা করে রূপদান করা হয়েছে। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সৌধটি ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দৃষ্টিগোচর হয়। স্থপতি মাইনুল হোসেন সৌধের মূল কাঠামোটি কংক্রিটের এবং কমপ্লেক্সের অন্যান্য স্থাপনা লাল ইট দিয়ে তৈরি করেন। মূল সৌধের গাম্ভীর্য ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্য এই পার্থক্য। এর দ্বারা রক্তের লাল জমিতে স্বাধীনতার স্বতন্ত্র উন্মেষ নির্দেশ করা হয়েছে।

এছাড়া, আশপাশের অন্য সকল নির্মাণ কাজের স্থাপত্য নকশা প্রণয়ন করেছে বাংলাদেশ সরকারের স্থাপত্য অধিদপ্তর।

অন্যদিকে, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ৭ বীরশ্রেষ্ঠ ও বঙ্গবন্ধুর সেই ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকেও এর সাথে সম্পৃক্ত করে থাকেন অনেকে। বিষয়টি একটু অন্যভাবেও আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। এই সালটির দুটি অঙ্কের যোগফল ৫+২= ৭। আবার ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। সেখানেও ১+৬ = ৭।

এ ছাড়াও আমরা ছোটবেলায় পড়েছি সাতে সমুদ্র। সেদিক থেকে ৭ অঙ্কটি সামনে আসে। আবার সাত আসমানের কথাও আমরা বলতে পারি। রংধনুর ৭টি রং, সাতদিনে সপ্তাহ ইত্যাদি কারণেও ৭ অঙ্কটি বেশ আলোচিত।

চারদিকে ইটের দেয়ালে ঘেরা জাতীয় স্মৃতিসৌধটি মুক্তিযুদ্ধের প্রথম স্মৃতিসৌধ। মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গকারী অসংখ্য শহিদদের স্মরণে নির্মিত বিভিন্ন স্মৃতিসৌধ ও ভাস্কর্যের মধ্যে প্রধানতমও এটি। এক কথায় জাতীয় স্মৃতিসৌধ আমাদের ইতিহাসের স্মারক। এর উঁচু মিনারটি নজরে পড়ে অনেক দূর থেকে।

লেখিকাঃ দেবযানী দত্ত

 

Porjotonlipi Desk

Add comment