Porjotonlipi

চায়ের দেশ শ্রীমঙ্গল

আচ্ছা চায়ের দেশ শ্রীমঙ্গল এর কথা শুনেছেন?  যখন অলসতা উঁকি দেয় ক্লান্ত শরীরে তখনই এই আলস্য দূর করতে সবচেয়ে কার্যকারী এবং দ্রুততর পদ্ধতি এক কাপ গরম চা। বাংলাদেশের মানুষের সকাল বিকাল চা পান একটি নিজস্ব রীতি আর চা উৎপাদনের কথা আসলে প্রথমেই যে জিনিসটার কথা আসে তা হলো চা বাগান। চা বাগান মানেই ‘অ্যাডভেঞ্চার’ বা রোমাঞ্চ। বাংলাদেশে চা বাগান শব্দটি শুনলে সিলেট, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার এই জায়গা গুলোর নাম মনে পড়ে। আশা করি বুঝতে পেরেছেন আজকে আমরা কোন স্থান নিয়ে আলোচনা করবো।

চা এর দেশ হিসেবে খ্যাত শ্রীমঙ্গল

Tea-Garden

চা এবং বাংলাদেশ

চা বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান অর্থকারী ফসল এবং আমাদের দেশে এই চা উৎপাদনের রয়েছে বিশাল ইতিহাস । চা চাষের জন্য আবাদি এলাকায় ৪০ শতাংশ ছায়ার প্রয়োজন এবং এই মাত্রার কম বেশি চা চাষের জন্য অনুপযোগী। এই কারণে পাহাড় ও প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে সিলেট অঞ্চল বেশি উপযোগী। ১৮৫৪ সালে সিলেট শহরের এয়ারপোর্ট রোডের কাছে মালনীছড়া চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত মালনীছড়া চা বাগানই প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান।  

বাংলাদেশে মোট ৭টি ভ্যালী রয়েছে এর মধ্যে সিলেট বিভাগে রয়েছে ৬টি। এই ভ্যালীতে মোট চা বাগানের সংখ্যা ১৩৮টি। শুধু শ্রীমঙ্গলে রয়েছে ৩৮টি চা বাগান। এ জন্য শ্রীমঙ্গলকে চায়ের রাজধানীও বলা হয়। 

চায়ের রাজ্য শ্রীমঙ্গল

শ্রীমঙ্গল শহরটা ছোট্ট, তবে বেশ গোছানো। এই শহরের সব স্থাপনার মাঝেই নান্দনিকতার ছাপ। শহরের বেশির ভাগটা জুড়েই রয়েছে চা-বাগান। এখানে আপনি যে দিকে-ই তাকাবেন দু’চোখ জুড়ে দেখবেন চায়ের বাগান। যা দেখলে চোখ জুড়ে খেলে যাবে এক অপরূপ সুন্দর ও সবুজের সমারোহ। কারণ শ্রীমঙ্গলের পূর্বদিকে কিছূ অংশ হাওর ছাড়া পুরো উপজেলা জুড়ে শুধু চা বাগান।

প্রকৃতি ও আকর্ষণ

আপনি যখন মাইলের পর মাইল চা বাগানের ভিতর দিয়ে চলবেন তখন আপনার মনে হবে বিশ্বের সকল সৌন্দর্য্য যেন আপনার সামনে। একটি রিকশা, মিশুক কিংবা প্রাইভেট কার নিয়ে প্রবেশ করুন চা বাগানের ভিতর। চা বাগানের ঢুকার পর মনে হবে ভিন্ন পরিবেশ। মনে হবে কোন শিল্পী যেন মনের মাধুরী মিশিয়ে স্তরে স্তরে সবুজকে সাজিয়ে রেখেছে। চারপাশে কেবল সবুজের মেলা। এখন আমরা জানবো শ্রীমঙ্গল এবং এর আশেপাশের কিছু স্থান যা আপনাকে মায়াজালের মতো আঁকড়ে ধরবে ।

Lawchara

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান

চায়ের দেশ শ্রীমঙ্গল থেকে ভানুগাছ-কমলগঞ্জ রাস্তায় ৭ কিলোমিটার এগুলেই লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। জীববৈচিত্র্য ও বন্যপ্রানীর মহামিলনের নান্দনিক সৌন্দর্য্যরে স্থান লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্য্য মন্ডিত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ট্রপিক্যাল ফরেস্ট’ খ্যাত। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এই উদ্যানে পশু-পাখি দর্শনের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান। যেখানে উঁচু-নিচু পাহাড়ের গায়ে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে হাজার হাজার প্রজাতির লাখ লাখ বৃক্ষ। ন্যাশনাল পার্কের প্রবেশ করা মাত্রই আপনি দেখবেন চারিদিকে হাল্কা অন্ধকার রাস্তায় দুপাশের বৃগুলো দিবাকরের আলোক রশ্মিকে আটকে রেখেছে। মাঝে মাঝে বৃসারির মগডালে চোখ রাখুন দেখবেন বানর আর হনুমান লাফালাফি করছে। একটু ভেতরে প্রবেশ করলে আপনার চোখে পড়বে খাটাস, বনমোরগ, উল্লুক, মেছোবাঘ, বন বিড়ালসহ বিভিন্ন জীবজন্তু আর পার্কের বিশাল বিশাল বৃরাজি, জীবজন্তুর হুঙ্কার, ঝিঝি পোকার শব্দ, বানরের লাফালাফি, ঝাঁকঝাঁক উল্লূকের ডাকাডাকি একটু সময়ের জন্য হলেও আপনার ব্যস্ত জীবনের কান্তি দুর করে মনে এনে দেবে প্রশান্তির ছোঁয়া। সীমিত শহরের ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে এখনও মানুষ পেতে চায় শ্যামল অভয়ারণ্যের ছোঁয়া কিংবা একটু নিস্তব্ধতার একাকিত্ব।

শ্যামলী

ভ্রমণ পিপাসুদের কথা ভেবেই চায়ের দেশ শ্রীমঙ্গল এর লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর শ্যামলীতে নির্মাণ করা হয়েছে একটি পিকনিক স্পট। সবুজের অপরূপ সাজে সজ্জিত শ্যামলী। প্রকৃতিপ্রেমিক, ভ্রমণ বিলাসী ও সৌন্দর্য পিপাসুদের জন্য একটি দর্শনীয় স্থান এটি। এর বাস্তবতা মেলে রাস্তায় দু’পাশে সারিবদ্ধ গাড়ির বহর দেখে। দিন দিন মানুষের ব্যস্ততা বাড়ছে, কাজের চাপে যান্ত্রিক মানুষগুলো একঘেঁয়েমির মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। তাই একঘেঁয়েমি থেকে মুক্তি পেতেই তারা ছূটে আসেন শান্ত, অনাবিল সবুজ প্রকৃতির কাছে। আর মানুষের এসব চাহিদা মেটাতেই বুঝি চির সবুজের সাজে সেজেছে শ্যামলী। পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে শ্যামলীর সুনাম ছড়িয়ে আছে সারাদেশে। এখানে রয়েছে নানা প্রকার বৃরাজি। দেশের আর কোথাও একই সাথে এত বৈচিত্র্যময় বৃক্ষ দেখা যায় না। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ভানুগাছ সড়ক ধরে ৭ কিঃমি দুরে শ্যামলীর অবস্থান। শ্রীমঙ্গল থেকে শ্যামলীর উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়র পর পরই প্রথমে চোখে পড়বে রাস্তার দু’পাশে দৃষ্টিজুড়ে চায়ের বাগান। নীল আকাশের নিচে সবুজের গালিচা, তারই একপাশে শরতের বাতাসে দোল খেয়ে যাচ্ছে কোমল কাশফুলগুলো।

নীলকন্ঠ চা কেবিনের ৭ রঙা চা

এক কাপে ৭ রঙা চা!  এটি উদ্ভাবন করেছেন রমেশ রাম গৌড়। আলোড়ন সৃষ্টিকারী রমেশের চায়ের দোকানে খুব সহজেই পৌছাতে পারেন। চায়ের দেশ শ্রীমঙ্গল শহরের কালিঘাট রোড ধরে এগিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের রাস্তায় যেতে বাম দিকে চেখে পড়বে বিজিবি’র ১৪ রাইফেলস ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর এলাকায় মিনি পার্কের আদলে গড়ে উঠা নীলকন্ঠ চা কেবিন। মিডিয়ার বদৌলতে তার আবিস্কৃত দু’ থেকে আট রঙা চা’র খ্যাতি দেশের সীমা ছাড়িয়ে পৌছে গেছে ভিনদেশে। দেশের উচ্চপদস্থ সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তা, বিভিন্ন দূতাবাসের রাস্ট্রদূত, রাজনীতিবিদ, চলচ্চিত্র ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত পর্যটকরা তাঁর চা’র স্বাদ নিয়েছেন। রমেশের সাথে তঁরা ছবি তুলেছেন। পরিদর্শন খাতায় লিখে গেছেন বিস্ময়কর রমেশের চা’র ভূয়সী প্রশংসা। এখানে পাবেন ১০ লেয়ারের চা। প্রতি কাপের দাম পড়বে ৩ টাকা থেকে ১শ’ টাকা পর্যন্ত। রমেশ রাম গৌড় ইতিমধ্যে তার গবেষণা চালিয়ে একই পাত্রে ১০ লেয়ারের চা আবিষ্কারের কৌশল আয়ত্ব করেছেন। চা খাওয়া শেষ হলে যদি সময় থাকে বিস্ময়কর রমেশ রাম গৌড়ের সাথে কথা বলে আসতে পারেন। ইতিমধ্যে রমেশকে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পর্যটকরা লক্ষাধিক টাকা মাসিক বেতনে চাকুরী দেয়াসহ লোভনীয় প্রস্তাব দিলেও রমেশ তাতে রাজী হননি। নিজের দেশের আবিষ্কার বাইরে নিয়ে যাবেন না বলে এসব প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। চা পান শেষে মন্তব্য খাতায় আপনার অভিমত ব্যক্ত করে আসতে পারেন। ও হ্যাঁ একই রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলে ফুল ছড়া চা বাগান ঘেষে রমেশের আরেকটি চা দোকান রয়েছে। মনিপুরী পাড়ায় প্রবেশ পথে নীলকণ্ঠ চা কেবিনে একই ধরনের চা পাওয়া যায়।

টি রিসোর্ট

টি-রিসোর্টটি উঁচু-নিচু পাহাড়ে ঘেরা। অপূর্ব সৌন্দর্য্য মন্ডিত এই টি-রিসোর্টের চারিদিকে আছে হরেক প্রজাতির গাছ-গাছালি। চায়ের দেশ শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দুরে শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ সড়কের পাশে ভাড়াউড়া চা বাগান সংলগ্ন ২৫.৮৩ একর জায়গার ওপর এই টি রিসোর্টের অবস্থান। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর চা বাগানে ঘেরা পাহাড়ের ওপর এই টি-রিসোর্ট অবস্থিত। অত্যন্ত সুরতি এই টি রিসোর্টে ১টি অফিস ভবন, ২টি ভিআইপি লাউঞ্জ, ১৪ টি বাংলো, ৯টি স্টাফ হাউস, ৫০টি শ্রমিক সেড, ২টি পাম্প হাউস, ১টি পানির ট্যাংক, ১টি জেনারেটর হাউস ও ১টি জ্বালানি স্টোরসহ একটি বিদেশী রেস্ট হাউসের সমতুল্য আসবাবপত্রসহ সকল সুযোগ সুবিধা রয়েছে। পর্যটকদের জন্য সুইমিংপুলসহ ১টি অত্যাধুনিক টেনিস কোর্ট ও ব্যাডমিন্টন কোর্ট ও রয়েছে। প্রতিটি কটেজে উন্নতমানের ড্রইং, ড্রাইনিং, কিচেন, স্টোর রুম ফ্রিজরুম, বাথরুমসহ ঠান্ডা ও গরম জলের ব্যবস্থা রয়েছে। টি-রিসোর্টে আগে থেকে বুকিং দিয়ে আপনি সহজেই এখানে থাকতে পারেন। এ এলাকাটি আপনাকে মুগ্ধ করবেই। শ্রীমঙ্গলে নেমে রিকশা বা টেক্সিতে করে আপনি ১০/১৫ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যেতে পারেন টি-রিসোর্টে। অবশ্য টি-রিসোর্টে আসার আগে আপনাকে অবশ্যই বুকিং দিতে হবে।

হাইল হাওর

১৯৯৭ সালের ১৪ জুন গভীর রাতে এ গ্যাসকুপে ড্রিলিংয়ের সময় অগ্নি বিস্ফোরণে আশপাশের খাসিয়া পুঞ্জি, চা বাগান, রেল লাইন, সবুজ বনাঞ্চল পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এই গ্যাসকুপটি এখন পরিত্যক্ত এবং সংরতি এলাকা। চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া। দর্শনার্থীরা এ এলাকায় বেড়াতে এসে অবাক বিস্ময়ে অবলোকন করে মাগুরছড়ার দৃশ্যাবলী। 

খাসিয়া পান পুঞ্জি

শ্রীমঙ্গল উপজেলার বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে খাসিয়া পানের পুঞ্জি। আপনি যখন পাহাড়ের উঁচুটিলায় খাসিয়াদের পান পুঞ্জি দেখতে যাবেন সেখানে পাবেন অন্যরকম এক অনুভূতি। টিলার পর টিলার যতোদুর পর্যন্ত দৃষ্টি যায়। শুধুই পান গাছের সারি চোখে পড়বে।

ডিনস্টন সিমেট্রি

শতবর্ষের স্মৃতিবিজড়িত ডিনস্টন সিমেট্রি। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে প্রায় ১৫কিলোমিটার দূরে ডিনস্টন চা বাগানে এর অবস্থান। পাহাড়টিলায় ঘেরা চিরসবুজ চা বাগানের ভেতর সুনসান নিরবতার মাঝে ডিনস্টন সিমেট্রিতে ঘুমিয়ে আছেন ৪৬ জন বিদেশী নাগরিক।

ভেষজ উদ্ভিদ বাগান

লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্কেই রয়েছে দেশের পূর্বাঞ্চলের একমাত্র ভেষজ বাগান আরোগ্য কুঞ্জ। মাগুর ছড়া গ্যাস কুপ পেরিয়ে প্রায় আড়াই কিঃমি পথ এগুলোই হাতের ডানদিকে চোখে পড়বে ভেষজ বাগান আরোগ্য কুঞ্জ। পার্কের ২ একর জায়গা জুড়ে বি¯তৃত এ ভেষজ বাগানে রয়েছে ৭৯ প্রজাতির ঔষধী গাছ।

Tea-Garden1

বাংলাদেশ চা গবেষনা ইনস্টিটিউট

চারদিকে বিচিত্র সব ফুলের আয়োজন। সারিবদ্ধ পাম, ইউক্যালিপটাস, একাশিয়া ইত্যাদি বৃরাজির শোভা। লেকের জলে ফুটন্ত জলপদ্ম। তারই মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই)। প্রকৃতি আর মানুষের হাতের ছোঁয়া গড়ে ওঠা এলাকাটির সৌন্দর্য্য নিঃসন্দেহে যে কাউকে মুগ্ধ করবে। চা গবেষনা ইনস্টিটিউট ছাড়াও এখানে রয়েছে একটি চা কারখানা। কর্তৃপরে অনুমতি নিয়ে বিজ্ঞানাগার ও চা কারখানায় চা প্রক্রিয়াজাতকরণ দেখার সুযোগ রয়েছে।

মণিপুরী পল্লী

১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ভাগ্যচন্দ্রের শাসনামলে মনিপুর রাজপুরুষ মোয়ারাংথেম গোবিন্দের নেত্বত্বে একদল মণিপুরী মণিপুর রাজ্য ছেড়ে শ্রীমঙ্গলের খাসপুরে এসে আবাস গড়েন। এই খাসপুরে রয়েছে মোয়ারাংথেম গোবিন্দের স্মৃতিস্তম্ভের ধ্বংসাবশেষ । যা একটি ঐতিহাসিক নির্দশন। স্বতন্ত্র কৃষ্টি-সভ্যতা, ভাষা-সংস্কৃতি, আচার-আচরণসমৃদ্ধ এক বৈশিষ্ট্যময় জনগোষ্ঠীর জীবনপ্রণালীর সঙ্গে পরিচিত হতে চাইলে আপনি এই পাড়ায় যেতে পারেন। এই পাড়ায় আপনি মণিপুরী মেয়েদের তাঁতে কাপড় বুননের দৃশ্য প্রত্য করতে পারেন। তাছাড়া আপনার পছন্দমতো শাড়ি, চাদর, ওড়না, বেড কভার ইত্যাদি ক্রয় করতে পারেন। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে কালিঘাট চা বাগানের রাস্তা ধরে ৫ কি.মি. পথ পেরিয়ে ডান দিকে খানিকটা রাস্তা। তারপরেই মণিপুরী পল্লী। মণিপুরীরাও অতিথি পরায়ন। তবে আপনার সঙ্গে মিশতে খানিকটা সময় তাদের দিতে হবে।

রাবার বাগান

শ্রীমঙ্গলে রয়েছে বন শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনের সিলেট বিভাগীয় অফিস। এ অফিসের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সরকারী ৪টি রাবার বাগান। এছাড়াও প্রায় প্রত্যেক বেসরকারী বাগানেও এখন রাবার চাষ করা হচ্ছে। আপনি ইচ্ছে করলে যে কোন একটি রাবার বাগান ঘুরে দেখতে পারেন এবং জানতে পারেন কিভাবে রাবার তৈরি হয়, জানতে পারেন রাবার শ্রমিকের জীবন। আপনি যখন হাজার হাজার রাবার গাছের মধ্য দিয়ে হাটবেন তখন আপনি দেখবেন গাছের ডালপালা পুরু আকাশটাকে ঢেঁকে রেখেছে। বন শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনের বাগানের মধ্যে হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে রয়েছে শাহজীবাজার রাবার বাগান, বাহুবল রয়েছে রুপাইছড়া রাবার বাগান, এবং মৌলভীবাজার শ্রীমঙ্গলের সাতগাঁও রাবার বাগান এবং কুলাউড়ায় রয়েছে ভাটরা রাবার বাগান।

আনারস বাগান

স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় শ্রীমঙ্গলের আনারসের খ্যাতি রয়েছে দেশ জুড়ে। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে যাওয়ার পথে চোখে পড়বে রাস্তার দু’পাশে আনারস বাগান।

লেবু বাগান

খুব ভোর উঠে যদি শ্রীমঙ্গলের বাজারে যান, তাহলে দেখবেন শুধু লেবু আর লেবু। নিজের চোখকেই অবিশ্বাস্য মনে হবে এতো লেবু শ্রীমঙ্গলে জন্মে।

ভাড়াউড়া লেক

চারদিকে চা বাগান মাঝখানে বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে একটি লেক। লেকে রয়েছে জলপদ্মের মেলা।দেখবেন শাপলা ফুল পরিপূর্ণ লেকটিতে হরেক রকম পাখির সমাহার। লেকের শাপলা ফুলগুলোর দিকে তাকালে মনে হবে সবুজের মধ্যে লালের ছোঁয়া। তবে এ লেকে যেতে হলে পাহাড়ের গা বেয়ে একটু হেঁটে যেতে হবে। হেঁটে চলার পথটি এতোই সুন্দর যে, হাঁটার কান্তি আপনিই ভুলে যাবেন।

ওফিং হিল

চমৎকার একটি জায়গা অফিং হিল। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে প্রথমে কালিঘাট চা বাগানে পৌঁছান। সেখানে থেকে হাতের বাম দিকে ইটা বিছানো রাস্তায় এগিয়ে যান। চা বাগান আর রাবার বাগানের মাঝ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ২০ মিনিটের মধ্যে পেয়ে যাবেন হুসনাবাদ চা বাগান। ইচ্ছে করলে গাড়িও নিতে পাবেন, সেখান থেকে হেঁটে আগর বাগানের দিকে এগিয়ে যান আগরের বাগান পেরুলেই দেখতে পাবেন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। মনে হবে যেন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পৌঁছে গেছেন। আর একটু এগুলোই পাহাড়ের ভিতরে পাবেন একটি লেক। শাপলা, জলপদ্মে ভরা লেকটির এক পাশ থেকে অপর পাশে দেখবেন শত শত পাকৌড়ি আর সরালী ভাসছে। লেকটি এঁকে-বেঁকে অনেক দুর চলে গেছে। একটু দুর বিধায় এ লেকে পর্যটকদের ভীড় হয় কম। লেকটির কাছে গেলে মনে হবে এটিকে যেন আপনিই আবিষ্কার করেছেন। এখানে আপনা আপনিই কেটে যাবে বেশ কিছুটা সময়।

যজ্ঞ কুন্ডের ঝর্ণা

শ্রীমঙ্গলে এসে শুধু সবুজের ছোঁয়া নিবেন তাতো হয়না একটু পানির ছলছল শব্দ শোনাওতো দরকার। তাই চলে যান শহরের কাছাকাছি জাগছড়া চা বাগানের ১৪নং সেকশনে যজ্ঞ কুন্ডের ধারায়। সেখানে রয়েছে অপরূপ সৌন্দর্য সমৃদ্ধ শ্রীমঙ্গলের একমাত্র ঝর্ণা। যারা এ ঝর্ণাকে প্রথম দেখবেন তারা অবশ্যই বিস্মিত হবেন। এটিও অপরূপ একটি সৃষ্টি। ঝর্ণাটি দেখতে আপনি শ্রীমঙ্গল শহর থেকে মৌলভীবাজার রোড হয়ে কাকিয়াবাজার নেমে ডান দিকে জাগছড়া চা বাগানে যাবেন অথবা শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ভাড়াউড়া ও সোনাছড়া চা বাগান হয়ে মেটো রাস্তায় জাগছড়া চা বাগানে গিয়ে যে কাউকে জিজ্ঞেস করে আপনি চলে যাবেন জাগছড়ার ১৪নং সেকশনে। সেখানে চোখে পড়বে একটি ব্রিজ। ব্রিজের ডান পাশ দিয়ে ছড়ার পাড় ধরে একটু সামনে এগিয়ে গেলেই শোনতে পাবেন শা শা শব্দ। নেমে পড়বেন পাহাড়ী ছড়ায় দেখবেন কোন যাদুকর মাটিতে অপরূপ কারুকাজ করে পানি প্রবাহের পথ করে দিয়েছেন।

বার্নিস টিলার আকাশ ছোঁয়া সবুজ মেলা

বার্নিস টিলার নামটা শুনেই মনে মধ্যে অজানাকে জানার জন্য আচমকা একটা শিহরণ দিয়ে উঠবে। আকাশ ছোঁয়া সবুজ মেলা দেখতে হলে আপনাকে অবশ্যই যেতে হবে বালিশিরা ভ্যালীর বার্নিশ টিলায়। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে কালিঘাট রোড হয়ে জিপে চড়ে অথবা রির্জাভ কার, লাইটেস, মিশুক, সিএনজি কিংবা রিকশা নিয়ে দুপাশে চা বাগানের মধ্য দিয়ে পিচ রাস্তা ধরে প্রায় ৫ কি: মি: পথ এগুলেই পাবেন ফিনলে হাউজ। এখানেই দাঁড়াতে হবে। দেখবেন পিচ রাস্তাটি চলে গেছে ডানদিকে, সোজা একটি মাটির রাস্তা চলে গেছে চা বাগানের বুকচিড়ে এবং আপনার কাংকিত বার্নিশ টিলার রাস্তাটি চলে গেছে পিচ রাস্তা থেকে বামদিকে ফিনলে হাউসের পাশ দিয়ে। এ রাস্তা ধরে এগুলোই আপনি দেখতে পাবেন ফিনলে রাবার ফ্যাক্টরী। মনে রাখবেন এই ফ্যাক্টরীতে একটি টিউবওয়েল রয়েছে। বার্নিশ টিলা দেখে ফেরার পথে পানি পিপাসা পেলে এখানেই পিপাসা মিটাতে হবে। ফিনলে রাবার ফ্যাক্টরী ছেড়ে একটু সামনে এগুলোই আবার চা বাগান এ চা বাগানের পথ ধরে একটু সামনে গিয়ে ডান দিকে এগুলোই চোখে পড়বে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৌধামনির বুকে সবুজ ডানা মেলে স্থির হয়ে আছে সু-উচ্চ টিলারাশি। আস্তে আস্তে যখন আপনি একটি টিলায় উঠে পড়বেন তখন আপনার বিশ্বাস করতেই কষ্ট হবে আপনি ভূ-পৃষ্টে দাঁড়িয়ে আছেন। মনে হবে বিমান কিংবা হেলিকপ্টার থেকে শ্রীমঙ্গল দেখছেন। টিলার একপাশে শুধু চা বাগান অন্যপাশে একের পর এক সবুজ টিলা। এ টিলার পরেই বাংলাদেশের সীমানার শেষ প্রান্তে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য।

নির্মাই শিববাড়ী

চায়ের দেশ শ্রীমঙ্গল এর ঐতিহ্যবাহী নির্মাই শিববাড়ী ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে একটি আকর্ষণীয় স্থান। এখানে শিব মন্দিরের পাশেই রয়েছে ৯ একর জায়গা জুড়ে বিশাল একটি দিঘী। দিঘীর চারপাশে বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির বৃসারি। এই দিঘীর পাড়ে বৃসারির নিচে বসে আড্ডা কিংবা গল্প করেই আপনি কাটিয়ে দিতে পারেন অনেকটা সময়। নির্মাই শিববাড়ীর আশেপাশের প্রবীন ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে আপনি জেনে নিতে পারেন এই মন্দিরের ইতিহাস।

সিতেশ দেবের মিনি চিড়িয়াখানা

সিতেশ রঞ্জন দেব। একসময়ের দুধ্বর্ষ শিকারী এখন প্রাণী সংরণবিদ ও পরিবেশবিদ। প্রকৃতি প্রেমী এ মানুষটির প্রেম বনের পশু-পাখিদের সাথে। শ্রীমঙ্গল শহরের মিশন রোডে তার বাসভবন। বাসার রাস্তা ধরেই পশ্চিম ভাড়াউড়া এলাকায় সম্পুর্ন ব্যাক্তিগত উদ্যোগে তিনি গড়ে তুলেছেন মিনি চিড়িয়াখানা।

প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা এবং বিকাল সাড়ে ৩টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সবার জন্য চিড়িয়াখানা খোলা থাকে।

মাধবপুর লেক

শ্রীমঙ্গল বেড়াতে এসে আপনি দেখে যেতে পারেন অন্যতম পর্যটনের স্থান মাধবপুর লেক। সকালে কিংবা বিকেলে শ্রীমঙ্গল থেকে একটি ভাড়া গাড়ি নিয়ে যেতে পারেন মাধবপুর লেকে। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে দুটি রাস্তায় সেখানে যাওয়া যায়। এটি শ্রীমঙ্গল থেকে ১৫ কি: মি: পূর্বে শ্রীমঙ্গলের পাশ্ববর্তী কমলগঞ্জের মাধবপুর চা বাগানে। লাউয়াছড়া প্রবেশের মূখে হাতের ডান দিকে নুরজাহান চা বাগানের ভিতর দিয়ে অথবা ভানুগাছ বাজার হয়ে সেখানে যাওয়া যায়। গাড়ি থেকে নামতেই আপনার চোখে পড়বে চারদিকে সবুজ পাহাড়। পাশাপাশি উঁচু-উঁচু টিলা। সমতল চা বাগানে শত শত গাছের সারি। হয়তো এরই মাঝে একঝাঁক পাখি আপনাদের আমন্ত্রণ জানাবে তার সুরের মুর্চ্ছনায়।হাজার হাজার ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকদের পদভারে পুরো বছরই মুখরিত থাকে এ লেক।

কিভাবে যাবেন চায়ের দেশ শ্রীমঙ্গল 

প্রতিদিন ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গলের পথে চারটি আন্তঃনগর ট্রেন যাত্রা করে কমলাপুর রেলষ্টেশন থেকে। এছাড়া সায়েদাবাদ থেকেও আসতে পারবেন চায়ের দেশ শ্রীমঙ্গলে ।

কোথায় থাকবেন

কোলাহল মুক্ত পরিবেশে থাকতে চাইলে উঠতে পারেন চা বাগানের ভিতর বিটিআরআই রেস্ট হাউজ অথবা টি রিসোর্ট-এ। এ ছাড়া শ্রীমঙ্গল শহরে ২০টিরও বেশি আবাসিক হোটেল রয়েছে। ভাল দেখে যে কোন একটিতে উঠতে পারেন। ভাড়া মোটামুটি কম। শ্রীমঙ্গল শহরে উখযোগ্য হোটেলগুলো হলো_ টি টাউন রেস্ট হাউজ, নিরালা রেস্ট হাউজ, এলাহী পস্নাজা, হোটেল বিরতি, আল-রহমান, হোটেল মুক্তা প্রভৃতিতে উঠতে পারেন। এছাড়াও সরকারি ও আধা সরকারী সংস্থাগুলোর বেশ কিছু বাংলো রয়েছে এখানে। তবে কর্তৃপক্ষের পূর্ব অনুমতি সাপেক্ষে এখানে ওঠতে পারেন।

টি-টাউন গেষ্ট হাউজঃ ০৮৬২৬৩৭০

মিড লেভেল সেন্ডি হোটেলঃ ০৮৬২২৪৩

টি রিসোর্টঃ ০৮৬২৬২০৭

কন্টেন্ট রাইটারঃ তাসনিয়া মাহবুব তৈশী

 

Porjotonlipi Desk

1 comment