Porjotonlipi

চাঁদরাত আর ঈদ উৎসব

চাঁদরাত আর ঈদ একই সুরে গাঁথা যেন এক মহিমান্বিত উৎসব। এই উৎসব নিয়ে আয়োজন চলতে থাকে দীর্ঘ এক মাস ধরে। এত আকাঙ্ক্ষা আর উদ্দীপনার যে সুর শুরু হয় চাঁদরাত দিয়ে, সেই চাঁদরাতের আনন্দ আর খুশি দেশজুড়ে এক অন্যরকম ঐতিহ্যের সৃষ্টি করেছে। 

চাঁদরাত ও উৎসবমুখর অপেক্ষা

মুসলমানদের উৎসব হিসেবে দুইটি ঈদকে প্রাধান্য দেয়া হয় যা আরবী মাস গণনা করে উদযাপন করা হয়। আরবী মাস চাঁদ দেখা সাপেক্ষে শুরু হয়। চান্দ্রবছরের নবম মাস রমজান, যা আমরা সিয়াম সাধনার মাধ্যমে পার করি, এবং দশম মাস শাওয়াল। শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখার রাতটিই ঈদের চাঁদ আর শাওয়াল মাসের প্রথম দিনটিই আমাদের ঈদ-উল-ফিতর। চাঁদরাত সম্পর্কে আমাদের ধারণা শুধুমাত্র আনন্দ উদযাপন আর পরের দিনের ঈদের খুশি নিয়ে থাকলেও ধর্মীয় দিক থেকে ঈদের চাঁদ দেখা সুন্নত ও ফরজে কিফায়া। তাই আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে চাঁদ উঠলো কি না তা টিভি ফেসবুকে অহরহ খবর থাকলেও, এই উৎসাহ উদ্দীপনা আজও কিছুমাত্র কমে যায় নি। 

মাসের ২৯ তম দিনের সন্ধ্যা থেকে পশ্চিম আকাশে নতুন চাঁদ দেখার মাধ্যমে নতুন মাস শুরু করা হয়, এই চাঁদ ক্ষনস্থায়ী হয়। তাই ২৯ রোজার ইফতার খাওয়ার পরপরই এক ফালি খুশি খোজার মত করে সকলে ঈদের চাঁদ খুজতে থাকে পশ্চিম আকাশে। ২৯ রোজায় চাঁদ খুঁজে না পেলেও ৩০ রোজায় চাঁদ খোঁজার আমেজ সমান তালে চলতে থাকে সারাবিশ্বে। 

চাঁদরাত এর আয়োজন

ঈদ নিয়ে সারা রমজান মাসজুড়ে আয়োজনের যেমন শেষ থাকে না, তেমনি উৎসাহের কমতি থাকে না চাঁদরাত নিয়েও। বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলভেদে এই উদযাপনের ভিন্নতা থাকলেও সকল আয়োজনের মূলকথা একটিই – আনন্দ ও কল্যাণ। সকল দেশেই ২৯ তম রোজার ইফতার শেষে চাঁদ দেখা শুরু করে। 

সৌদি আরবে রাষ্ট্রীয় প্রচারের মাধ্যমে সকলকে চাঁদ দেখার জন্য আহ্বান জানানো হয়, এবং জনসাধারন বাড়ির ছাদ, উঁচু টিলা, বা টেলিস্কোপ নিয়ে চাঁদ দেখার চেষ্টা করে, এবং চাঁদ দেখা গেলে ছোট বাচ্চারা “দফ” নামক বাদ্যযন্ত্র নিয়ে অভিনন্দন জানাতে পথে নেমে আসে। মিসরে চাঁদ দেখতে পাওয়ার পরপরই বাজারে পরিবারের কর্তারা ঈদের সদাই কিনতে ভীর জমায়, রাস্তাঘাট বাড়ি গুলো রঙিন কাগজ দিয়ে উৎসবমুখর করে সাজানো হয়, শিশুরা লণ্ঠন হাতে পথে বের হয়ে ঐতিহ্যবাহী মিসরীয় গান গাইতে থাকে। তুর্কিরা চাঁদ দেখার জন্য সকলে একত্রিত হয়, এবং একসাথে চাঁদ দেখে, সারা বাড়িতে মিশক, অম্বর, গোলাপ জলের ঘ্রাণে ম ম করতে থাকে এবং রমজানে তাদের মসজিদ আলোকসজ্জা করা হয়ে থাকে। 

অন্যান্য দেশের আয়োজন পর্যালোচনা করলেও জানা যায় চাঁদরাত সকল দেশেই একটি আনন্দময় রাত, এর উৎসাহ উদ্দীপনা শিশু বয়স্ক সকলের কাছেই সমান। ঈদের আনন্দ শুরু হয় এই চাঁদ দেখার আনন্দের সাথে সাথে। 

বাংলাদেশের চাঁদরাত ঐতিহ্য 

বাংলাদেশে অনেক সময়, শেষ রোজায় একসাথে চাঁদ দেখবে বলে বন্ধুরা মিলে একসাথে ইফতারের আয়োজন করে। এছাড়াও ঈদ উপলক্ষে বাড়িতে আগমন হয় আত্মীয়স্বজনদের। এই ঈদের চাঁদ দেখার জন্যই ইফতারের পরপরই এলাকার শিশু কিশোর থেকে শুরু কিরে বয়স্করাও মাঠে জমায়েত হয়, শহর এলাকাগুলোয় পরিবারের সকলে একত্রিত হয় বাড়ির ছাদে বা খোলা বারান্দায়। চোখের নজর ঘুরে বেড়ায় সম্পূর্ন পশ্চিমাকাশে, এক ফালি চাঁদ দেখতে পাওয়ার জন্য। চাঁদ দেখার সাথে সাথেই বিটিভি তে শুরু হয় কাজী নজরুল ইসলামের মনকাড়া সেই গান, “ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।” প্রত্যেক বাড়িতে বাড়িতে ফুল ভলিউমে বাজতে থাকে গানটি, মুহুর্তেই ঈদের আনন্দে মন ছেয়ে যায়। অন্যান্য টেলিভিশন চ্যানেলেও প্রচার হতে থাকে চাঁদরাত উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান। আর এলাকার দস্যি ছেলেরা একের পর এক পটকা বাজি ফোটানো শুরু করে, শিশুরা মেতে উঠে তারাবাতির ঝিকমিকি আলো নিয়ে। এর ভেতরই এক চাপা উত্তেজনা নিয়ে আসে এলাকার গার্ডরা, যাদের প্রধান দায়িত্ব থাকে দস্যি ছেলেদের পটকা ফোটানো বন্ধ করা, কিন্তু পটকা ফোটানো চলতে থাকে মাঝরাত অব্দি, নিজেদের শৈশবের কথা ভেবে গার্ডরা দস্যিদের ছাড় দেয় নাকি আসলেই তারা ব্যর্থ হয় জানা নেই। এতসব পটকার শব্দের ভেতর চলুন ফিরে যাই বাড়ির ভিতরের দৃশ্য দেখতে। ঈদের আয়োজনের শেষ মুহুর্তের বাজারের লিস্টের সাথে মিলানো হয় কিছু লাগবে কি না, বাদ পরল কি না। সকল তদারকির পর বাড়ির কর্তা চলে যায় বাজারে বা নিত্যদিনের আড্ডায়, নিজের সহকর্মী, প্রতিবেশিদের সাথে দেখাসাক্ষাৎ করতে। গিন্নী ব্যস্ত হয় পরের দিনের রান্নাবান্নার প্রস্তুতি নিতে। অনেকে চলে যায় শেষ সময়ে টেইলার্স থেকে ঈদের দিনের জন্য কাঙ্ক্ষিত পোশাক নিয়ে আসতে। এতসকল আয়োজনের মধ্যে এক বিশেষ আয়োজন চলে এলাকার মেয়েদের মাঝে। কোন এক বাড়িতে জমায়েত হয়ে সকল মেয়েদের মাঝে মেহেদি দিয়ে দেয়ার এক অসাধারণ আসর জমে উঠে। একসাথে বসে তারা একে অপরকে মেহেদি দিয়ে দেয়, রঙ্গিন নকশায় সাজিয়ে তোলে দুই হাত। সাথে বাজতে থাকে চিরচেনা ঈদের গান। শিশুরা একে অপরকে রঙিন ঈদকার্ড দিয়ে ছন্দে ছন্দে বাড়িতে ঈদের দাওয়াত দেয়। অনেক রাত পর্যন্ত চলতে থাকে পটকা বাজি, মেহেদি দেয়া, শুভেচ্ছা বিনিময়। চাঁদ রাতের এসকল সৌন্দর্য আয়োজন ঈদকে ঘিরে। 

ঈদের আমেজ 

চাঁদরাত থেকে শুরু হওয়া সকল আয়োজন পূর্ণতা পায় ঈদের দিনের মাঝে। আগের দিনের গিন্নীর রান্নার আয়োজন পূর্ণতা পায় টেবিলে হরেক রকম রান্নার মাঝে, মেয়েদের হাতে শোভা পায় মেহেদির রঙিন নকশা, পরিষ্কার পাঞ্জাবী পরে ও সুগন্ধী মেখে বাড়ির ছেলেরা ঈদগাহে যায় ঈদের নামাজ পড়তে। নামাজ শেষে দলবেধে সকলে ঘুরে বেড়ায় প্রতিবেশি ও বন্ধু বান্ধব দের বাড়িতে। ছোট মেয়েরা ঈদের দিনেও ভীর করে পাশের বাড়ির আপুর কাছে পরিপাটি হয়ে সাজার জন্য। আর ঈদের দিনের অন্যতম আনন্দ ঈদী বা সালামী। গুরুজনেরা তাদের ভালবাসা স্নেহ প্রকাশ করে ঈদী দিয়ে থাকে। ছোটদের মাঝে থাকে এক অসাধারন অনুভূতি, কে কত ঈদী জমালো, আর এই ঈদী দিয়ে কি কি করা হবে। দলবেধে সকলে একে একে বন্ধু বান্ধবীদের বাড়ি বেড়াতে যায়, মিষ্টি কথা কাটাকাটি হয় কার বাড়িতে আগে পরে যাওয়া হবে তা নিয়ে। সকল আনন্দ উত্তেজনার মাঝে ঈদের দিন টি কাটে মুখরোচক খাবার, ঈদী, ঘুরে বেড়ানো, প্রিয় মানুষদের সাথে কাটানো খুশির সময়কে কেন্দ্র করে। 

তবে নতুন প্রজন্ম চাঁদ দেখার আনন্দ অনেকটাই অনুধাবন করতে পারে না আধুনিক ফেসবুক আর টিভির কারনে, সাধারন একটি কথা আজ আমাদের মাঝে প্রচলিত, সৌদি আরবে কাল ঈদ মানে আমাদের এখানে পরশু ঈদ হবে, এই একটি ধারণাই উত্তেজনায় বাঁধা দেয় বারবার। আধুনিকতার ছোঁয়া থেকে বের হয়ে আসুন পরিবারের সাথে চাঁদ দেখতে ভীর জমাই ছাদে বা বারান্দায়, “ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ” বাজিয়ে জানান দেই চাঁদের উপস্থিতির, ফেসবুকে অভিবাদন জানালেও বন্ধুদের সাথে রাস্তায় বের হয়েও সময় কাটাই, বাড়িতে সাহায্য করি পরের দিনের মুখরোচক আয়োজন করতে। 

চাঁদরাত থেকেই উপভোগ করুন আপনার ঈদের খুশি ও আনন্দ। সবশেষে সকলকে জানাই ঈদ মোবারক। কল্যান ও সমৃদ্ধময় হোক আপনার ঈদের দিনটি।

কন্টেন্ট রাইটার- সুমাইয়া নাসরিন তামান্না

 

Porjotonlipi Desk

Add comment