আশা করি আপনাদের অপরূপ বন্দর নগরী অপরূপ চট্টগ্রাম নিয়ে প্রথম পর্বটি ভালো লেগেছে। আজকে আপনাদের সামনে তুলে ধরব চট্টগ্রামের আরও কয়েকটি দর্শনীয় স্থান, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি।
বন্দর নগরী খ্যাত অপরূপ চট্টগ্রাম / চাটগাঁও এর দ্বিতীয় পর্ব
কোর্ট বিল্ডিং
১৫৩,০০০ বর্গফুটের উপর নির্মিত এই দ্বিতল প্রশাসনিক ভবনটি অপরূপ চট্টগ্রাম এর লালদিঘী পরীর পাহাড়ে অবস্থিত। ১৭৭৩ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কর্তৃক চট্টগ্রাম একটি প্রশাসনিক অঞ্চল এর খেতাব পায় এবং বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজ সম্পন্নের উদ্দেশ্যে এই ভবনের নির্মাণ হয়। সেখান থেকেই জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনার ও আদালতের কার্যাবলী পরিচালিত হয়, এবং সেখানেই জেলা ট্রেজারি অবস্থিত।
ডিসি হিল
অপরূপ চট্টগ্রাম এর জিরো পয়েন্টের কাছাকাছি বৌদ্ধ মন্দির সড়কে পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত ডেপুটি কমিশনারের বাসভবন, সেভাবেই পাহাড়ের নাম রাখা হয়েছে ডিসি হিল। এখানে একটি পার্ক রয়েছে। ফুল এবং ফলের গাছের ব্যাপক সমাহার নিয়ে সজ্জিত এই পাহাড়টির রয়েছে বিচিত্র এক সৌন্দর্য। বাংলা বছরের পহেলা বৈশাখে পাহাড়ের ঢালে আয়োজন করা হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের, যেখানে ঘটে হাজারো মানুষের মিলনমেলা। ১৯৭০ এর দশকের শেষভাগ থেকেই এখানে পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণ উৎসব পালিত হয়ে আসছে। পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান আগে ইস্পাহানী পাহাড়ের পাদদেশে উদযাপন করা হলেও ১৯৭৮ সালে এই উৎসব ডিসি হিল পার্কে সরিয়ে নেওয়া হয়। ১৯৭৮ সালের উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ওয়াহিদুল হক, নির্মল মিত্র, মিহির নন্দী, অরুন দাশ গুপ্ত, আবুল মোমেন সুভাষ দে প্রমুখ। প্রথম দিকে প্রত্যেক সংগঠন থেকে দুইজন করে নিয়ে একটি স্কোয়াড গঠন করা হত। সেই স্কোয়াডই সম্মিলিত সঙ্গীত পরিবেশন করতো। ১৯৮০ সাল থেকে সংগঠনগুলো আলাদাভাবে গান পরিবেশন শুরু করে। পরে গ্রুপ থিয়েটার সমন্বয় পরিষদ যুক্ত হওয়ার পর অনুষ্ঠানে নাটকও যুক্ত হয়েছে।
বায়েজিদ বোস্তামী’র মাজার
১২ সন্ন্যাসীর ভূমি এই অপরূপ চট্টগ্রাম এ অনেক মাজার থাকলেও ইরানের পারস্য সুফী বায়েজিদ বোস্তামী ’র মাজারই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে বছরের পর বছর। মাজারটি চট্টগ্রাম এর নাসিরাবাদে একটি পাহাড়ের উপরে অবস্থিত। এই মাজার চট্টগ্রামের ধর্মপ্রাণ মানুষের পাশাপাশি চট্টগ্রামে আসা দেশী বিদেশী পর্যটকদের জন্য একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থান।
এই সমাধির অবয়ব সর্বপ্রথম ১৮৩১ সালে পাহাড়ের উপরিভাগে একটি দেয়ালঘেরা আঙ্গিনার মাঝে আবিস্কার করা হয়। আঙ্গিনার ঠিক মাঝামাঝি একটি শবাধার অবস্থিত। পরবর্তীতে সমাধিস্থলটি আধুনিক কাঠামো দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। সমাধি পাহাড়ের পাদদেশে একটি তিন গম্বুজ বিশিষ্ঠ মোঘলরীতির আয়তাকার মসজিদ এবং একটি বিশালাকার দীঘি আছে। স্থাপত্যশৈলী থেকে ধারণা করা হয় মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব এর আমলে মসজিদটি নির্মিত।
অপরূপ চট্টগ্রাম এর পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত
পতেঙ্গা চট্টগ্রাম শহরের ১৪ কিলোমিটার দক্ষিণে কর্ণফুলী নদীর মোহনায় অবস্থিত একটি সমুদ্র সৈকত। সৈকতটি মূলত সমুদ্রের পরিষ্কার নীল পানির জন্য বহুল পরিচিত। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণীঝড়ে এই সৈকতটি ভয়াবহ ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বর্তমানে সমুদ্র সৈকতে সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করা বেড়ি বাঁধ দেয়া হয়েছে।
শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ঘাঁটি বিএনএস ঈসা খান পতেঙ্গার সন্নিকটে অবস্থিত। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের অনেক জেটি এখানে অবস্থিত।
ভাটিয়ারী গলফ অ্যান্ড কান্ট্রি ক্লাব
চট্টগ্রাম শহর থেকে মাত্র ১৫ কি.মি. দূরেই প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে গড়ে উঠেছে ভাটিয়ারী গলফ এ্যান্ড কান্ট্রি ক্লাব। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে গড়ে ওঠা এই গলফ ক্লাবের সদস্য প্রায় ৮শ’, এবং এটি দেশের ১২ টি গলফ ক্লাবের মধ্যে সেরা। এটি বাংলাদেশের ২য় বৃহত্তম এবং সবচেয়ে মান সম্পন্নগলফ ক্লাব। এখানে সারা বছর ধরে নানা দেশী এবং আন্তর্জাতিক গলফ টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮৪ সালের ১৮ মার্চ ক্লাবের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, একই বছরের ১১ এপ্রিল ক্লাবটি একটি রেজিস্টার্ড কোম্পানি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা এ মাঠের দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে ৬হাজার গজ। পাহাড়ীপথের শুরুটাই এমন যে তাক লাগিয়ে দেয় আগতদের। রাস্তার দু’ধারে রয়েছে জোড়া লেক, সামনেই রয়েছে এক গলফারের ভাস্কর্য। প্রাকৃতিক জলাধার এবং পাহাড় দিয়ে আবৃত এ ক্লাবে রয়েছে প্রাকৃতিক জলাধার এবং পাহাড়, ফলস্বরূপ এখানে হাজারো প্রজাতির ফুল-ফলের গাছ রয়েছে, এবং দেখা যায় বিভিন্ন প্রজাতির দেশি এবং অতিথি পাখিদের।
ভাটিয়ারী-হাটহাজারী সড়কে মিনিট খানেক এগুলেই ক্লাবের পাহাড়ীপথের শুরু। এই এলাকা বাংলাদেশ মিলিটারী একাডেমী র নিয়ন্ত্রণাধীন, যে কারণে ভ্রমণকারীরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি সাপেক্ষে এ এলাকা ভ্রমন করতে পারবেন। আপনি এলাকায় প্রবেশ করার সময় কোন ক্যামেরা, রেকর্ডিং ডিভাইস আনতে পারবেন না এবং এ এলাকার কোন ছবি তুলতে পারবেন না।
অপরূপ চট্টগ্রাম এর সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য
বাংলাদেশের সকল জেলারই নিজস্ব কিছু সংস্কৃতি রয়েছে, সেই তুলনায় চট্টগ্রামের ঐতিহ্য বেশ সুপ্রাচীন। একসময়ে চট্টগ্রামে আরাকানীদের শাসন ছিল, ফলে এই সংস্কৃতিতে আরাকানী মঘীদের বেশ স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। একসময়কার রাজা বাদশাদের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অনুসারিদের এখনও দেখা যায়। চট্টগ্রামের বর্তমান সংস্কৃতির উদ্ভব হয় ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি র প্রবর্তনের পরে। অন্যান্য স্থানের মতো চট্টগ্রামেও একটি নতুন মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। নতুন এরই ফাঁকে ইংরেজরা প্রচলনা করে ইংরেজি শিক্ষা। মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের ইতিহাস সমৃদ্ধ। আঞ্চলিক গান, মাইজভান্ডারী গান ও কবিয়াল গান চট্টগ্রামের অন্যতম ঐতিহ্য। জনপ্রিয় ব্যান্ড সোলস, এল আর বি, রেনেসাঁ, নগরবাউল এর জন্ম চট্টগ্রাম থেকেই। মাস্টার দা সূর্যসেন, প্রীতিলতার মত দেশপ্রেমিক যেমন এ মাটি জন্ম দিয়েছে, তেমনই জন্ম দিয়েছে নোবেলজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনুসের মত মানুষকে। আইয়ুব বাচ্চু, কুমার বিশ্বজিৎ, রবি চৌধুরী, নকীব খান, পার্থ বড়ুয়া, সন্দীপন, নাসিম আলি খান, মিলা ইসলাম চট্টগ্রামের সন্তান। এছাড়া চট্টগ্রামের মানুষ আতিথেয়তার জন্য দেশ বিখ্যাত।
ঐতিহ্য স্বরূপ চাঁটগাইয়াদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা। কলকাতায় তাদের সাহিত্য সংস্কৃতি রক্ষায় গড়ে ওঠার দেড় বছর আগে ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়।
ভোজনরসিকদের জন্য চট্টগ্রাম এক আবেদনময়ী নাম। এই জেলার মেজবানি মাংস সব জেলার মানুষের কাছেই পরিচিত এবং বেশ জনপ্রিয়। আরও আছে গণি বেকারির বেলা বিস্কুট । পূর্বপুরুষের হাত ধরে ১৮৭৮ সালে বেকারি শিল্পে যুক্ত হন এই কারিগর, যিনি গণি বেকারিকে নিয়ে গিয়েছেন এক অনন্য উচ্চতায়। বিকেলে বা সকালে চায়ের সাথে ‘টা’ হিসেবে গণি বেকারির বেলা বিস্কুট চট্টগ্রামের মানুষের প্রথম পছন্দ। বিস্কুট উৎপাদনে যুগান্তকারী সব বদল আসলেও বেলা বিস্কুট উৎপাদনে এখনও সেই মাটির তন্দুরি চুলাইই ব্যবহার হয়। ঠিক যেমন মোগল আমলে খেয়েছিলেন মোগল বাদশাহরা। তালিকায় আরেকটি যে খাবারের নাম যোগ করা যেতে পারে, সেটি হল আখনি বিরিয়ানি । এই বিরিয়ানি নিয়ে সিলেট এবং চট্টগ্রামের মধ্যে চলে দ্বন্দ্ব, তবে দুই জেলার বিরিয়ানিই বেশ প্রসিদ্ধ। চট্টগ্রামের আখনি বিরিয়ানি অনেক বেশি মসলাদার হয়ে থাকে।
Add comment