বন্দর নগরী চট্টগ্রাম হচ্ছে ঢাকার পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর। ঐতিহ্যবাহী চাটগাঁও যেটি আমাদের কাছে চট্টগ্রাম নামেই পরিচিত। এটি এশিয়ার ৭ম এবং বিশ্বের ১০ম দ্রুততম ক্রমবর্ধমান শহর। পর্তুগিজ শাসনামলে এর নাম ছিল পোর্তো গ্রান্দে দে বেঙ্গালা বা বড় বন্দর, এবং মোঘল শাসনামলে যখন এটিকে রাজধানী ঘোষণা করা হয়, এর নামকরণ করা হয় ইসলামাবাদ ।
বন্দর নগরী খ্যাত চট্টগ্রাম / চাটগাঁও
এই বিশাল জেলায় বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানের পাশাপাশি রয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থান এবং আমাদের পর্যটনলিপি র অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে চাটগাঁও এবং তার আশেপাশের বেশকিছু জায়গা। আজকে আমরা জানব এই জেলার কিছু ইতিহাস এবং কিছু দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে।
বন্দর নগরী চট্টগ্রাম এর ইতিহাস ও নামকরণ
বাংলা ইতিহাসের চন্দ্রবংশের রাজা সু-লা-তাইং-সন্দয়া ৯৫৩ সালে চট্টগ্রাম অভিযানে আসলে বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেন না, কিন্তু তিনি একটি স্তম্ভ স্থাপন করেন যেটির গায়ে খোঁদাই করা হয় চেৎ-ত-গঙ্গ যার অর্থ ‘যুদ্ধ করা অনুচিত’। আরাকানি পুথি রাজাওয়াং – এ বলা হয়েছে, সে স্তম্ভ থেকেই এলাকাটির নাম হয় চৈত্তগৌং এবং কালক্রমে এই শব্দটি চাটিগ্রাম, চাটগাঁ, চট্টগ্রাম, চিটাগাং ইত্যাদি বানানের চল শুরু হয়। ডাচ বা ওলন্দাজ শাসনামলে একে ডাকা হত যেটিগাম (Xetigam)।
পর্তুগিজ জলদস্যিতার কথা আমরা কমবেশি সবাই জানি। ১৫১৭ সালে পর্তুগিজ জলদস্যু চট্টগ্রামে খুঁটি গাড়ে এবং তারা বানিজ্যের চেয়ে দস্যিপনাকে বেশি প্রাধান্য দেয়। সামরিক সহায়তা দিয়ে পর্তুগিজরা ১৫৩৭ সালে চট্টগ্রামে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে।
এরপরে ১৬৬৬ সালে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব সুবেদার শায়েস্তা খানকে চট্টগ্রাম দখলের নির্দেশ দেন। সেনাপতি উমেদ খান প্রথম ফৌজদারির দায়িত্ব পান। জেলার প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে ওঠে এই মুঘল আমলে। মুঘল শাসকরা জেলাটিকে কয়েকটি পরগণায় বিভক্ত করে এবং দীর্ঘ ৯৪ বছর শাসন করে। তখন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা বর্তমান তিন পার্বত্য জেলা এ চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্ভূক্ত ছিল। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম পার্বত্য এলাকা নামে আলাদা একটা প্রশাসনিক ইউনিট গড়ে উঠে এবং ১৮৮১ খ্রীস্টাব্দে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্যে স্থায়ী সীমারেখা টানা হয়।
দর্শনীয় স্থান
চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের প্রবেশদ্বার বলা হয়। এটি বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী। এই নগরীতে ঘুরে দেখার মত অনেক জায়গা রয়েছে।
ফয়’স লেক
ফয়েজলেক (ইংরেজি: Foy’s Lake) চট্টগ্রামের পাহাড়তলী রেলস্টেশন এর অদূরে (চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্র থেকে ৮ কিমি. দূরে) খুলশি এলাকায় অবস্থিত একটি কৃত্রিম হ্রদ। এটি ১৯২৪ সালে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কতৃপক্ষ এর তত্ত্বাবধানে খনন করা হয় এবং সেসময় পাহারতলী লেক হিসেবে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে ইংরেজ রেলপ্রকৌশলী ফয় (Foy) এর নামে নামকরণ করা হয়। বর্তমানে এটির মালিকানা বাংলাদেশ রেলওয়ের। বেশ বড় মাপের (৩৩৬ একর জমির উপর) এই লেকটি পাহাড়ের এক শীর্ষ থেকে আরেক শীর্ষের মধ্যবর্তী একটি সংকীর্ণ উপত্যকায় আড়াআড়ি ভাবে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে সৃষ্ট। আড়াআড়ি ভাবে নির্মিত বাঁধটি চট্টগ্রাম শহরের উত্তর দিকের পাহাড় শ্রেণীর থেকে নেমে আসা পানির প্রবাহের দিক পরিবর্তনের মাধ্যমে এই লেকটিকে সৃষ্টি করেছে। ভুতাত্ত্বিকভাবে এইসব পাহাড় শ্রেণী দুপিটিলা স্তর সমষ্টির শিলা দ্বারা গঠিত। ফয়’স লেকের পাশেই আছে চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় বাটালি হিল। পাহারতলী রেলস্টেশন এর দক্ষিন কোল ঘেঁষে আরেকটি কৃত্রিম হ্রদ রয়েছে। ফয়’স লেক তৈরির পূর্বে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কতৃপক্ষ ১৯২০ সালে এটি খনন করে। দুটি লেকই আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে দেশি বিদেশী পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয়।
বর্তমানে হ্রদটিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান কনকর্ড একটি বিনোদন পার্ক স্থাপন করেছে যেখানে দর্শনার্থীদের জন্য লেকে নৌকা ভ্রমন, রেস্তোরা, ট্র্যাকিং এবং কনসার্ট এর আয়োজন করা হয়ে থাকে। বর্তমানে এখানে বিরল প্রজাতির পাখি এবং ডিয়ার পার্কে হরিণ দেখার ব্যবস্থা আছে। ফয়’স লেকের পাশেই অবস্থিত চট্টগ্রামের চিড়িয়াখানা। এছারাও দর্শনার্থীরা কটেজ ভাড়া করে থাকতে পারেন। ফয়’স লেকের আশেপাশের মনোরম পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আকর্ষণে প্রতি বছর দেশি বিদেশি বহু পর্যটক ছুটে আসেন।
জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর
এই জাদুঘরটি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম শহরের আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান, যেটি ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তখন থেকেই এটি জনসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হয়। জাদুঘরটি মূলত দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর উত্তরাধিকার ও তাদের জীবনপ্রণালী সম্পর্কে দর্শনার্থীদের ধারণা দেওয়ার নিমিত্তে প্রতিষ্ঠিত। এটি গবেষণা কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
কমনওয়েলথ ওয়ার সেমেট্রি
কবরস্থানটি চট্টগ্রামের দামপাড়া এলাকায়, ১৯ নং বাদশা মিয়া সড়কে অবস্থিত। এটি চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে ২২ কিমি উত্তরে এবং চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৮ কিমি দূরে অবস্থিত। প্রতিষ্ঠাকালে এই এলাকাটি একটি বিশাল ধানের ক্ষেত ছিল, যদিও বর্তমানে এটি বেশ উন্নত এলাকা এবং শহরের প্রানকেন্দ্র হিসেবে পরিগনিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম ওয়ার সেমেট্রি প্রতিষ্ঠা করেন। সূচনালগ্নে এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত জাতীয় বিদেশী সৈন্যদের প্রায় ২০টি (১জন ডাচ এবং ১৯জন জাপানি) সমাধিসহ প্রায় ৪০০টি কবর ছিল। তবে বর্তমানে এখানে ৭৩১ টি কবর বিদ্যমান যার ১৭টি অজানা ব্যক্তির। এছাড়া এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫) চট্টগ্রাম-বোম্বের একটি স্মারক বিদ্যমান।
[…] করি আপনাদের চাটগাঁও এর প্রথম পর্বটি ভালো লেগেছে। আজকে আপনাদের সামনে তুলে […]