গোপালগঞ্জ জেলা ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত ১৩ টি জেলার একটি জেলা, যেটি মধুমতি নদীর পাশে অবস্থিত। এই জেলায় প্রায় ১১লাখ মানুষের বসতি রয়েছে। ধারণা করা হয়, বল্লাল সেন এর আমলে এই জেলার পূর্বাঞ্চলের খাটরা গ্রামের কিছু হিন্দু ধর্মাবলম্বী অধিবাসীরা এই অঞ্চলে সর্বপ্রথম বসতি স্থাপন করে।
গোপালগঞ্জ জেলা দর্শনীয় কিছু স্থান
গোপালগঞ্জ জেলায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সমাধিস্থলের পাশাপাশি আছে কিছু প্রাচীন নিদর্শনাদি যেগুলোর মধ্যে চন্দ্রভর্মা ফোর্ট (আরেক নাম কোটাল দুর্গ), বহলতলী মসজিদ (নির্মাণকাল ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দ), সেন্ট মথুরনাথ এজি চার্চ, শ্রীধাম ওড়াকান্দির শ্রী হরিমন্দির, ননী ক্ষীরের নবরত্ন মন্দির, কোর্ট মসজিদ, কেন্দ্রীয় কালীবাড়ি, দীঘলিয়া দক্ষিণা কালীবাড়ি উল্লেখযোগ্য।
জমিদার গিরীশ চন্দ্র সেন- এর বাড়ি
গিরীশ চন্দ্র সেনের বেশ পুরনো এই দালানটি ইংরেজি U অক্ষরের আদলে নির্মিত, তৎকালীন সময়ে এটি মানুষের বেশ নজর কাড়ত। নয়নাভিরাম এই বাড়িটির মধ্যঅংশ ছিল দ্বিতল বিশিষ্ট এবং তারই লাগোয়া দুপাশে ছিল একতলা বিশিষ্ট ভবন। সাদা রঙের জমিদারি ভবনটি মোটামুটি সুরক্ষিত ছিল বলা যায়। প্রাচীর বেষ্টিত বাড়ির পিছনে তিনদিক থেকে ছিল বিভিন্ন ধরনের ফলের গাছ। বাড়িটির বামপাশে ছিল একতলা ভবন বিশিষ্ট মন্দির এবং ডান পাশে ছনের ছাউনি দিয়ে কাচাড়ী। দৃষ্টিনন্দন বলতে যা বোঝায় তার কোন অংশেরই কমতি ছিল না এই বাড়িটিতে। জমিদার বাড়ির বিশালাকার পুকুরটি ছিল সুশোভিত। শান বাঁধান পুকুরটি নিঃস্বার্থভাবে সেবা দিয়েছে জমিদার বাড়িকে, এলাকার জনগণকে।এখন আর সেই কাচা রাস্তাও নেই, নেই সেই জমিদার বাড়িও। পরিচিতি গেছে পাল্টে। এখন শুধু এটুকুই পরিচয় কাশিয়ানী এম.এ খালেক সরকারী বালিকা বিদ্যালয় এর দক্ষিণ পার্শ্বস্থ কাশিয়ানী এম.এ খালেক ডিগ্রী কলেজ এর প্রাক্তন অধ্যক্ষের বাড়িটিই তখনকার জমিদার গিরীশ চন্দ্র সেনের বাড়ির ভিটা।
অন্যন্যা চন্দ্র ঘাট
গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা সংলগ্ন দীঘিতে ১৯৫৮ সালে একটি ঘাটলা নির্মাণ করা হয়। তদানিন্তন সার্কেল অফিসার (সি, ও, ডেভঃ) জনাব এস এম এ কাশেম বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে নগদ ৩,০০০/- টাকা পুরস্কার পান এবং ঘাটলা নির্মাণের জন্য তিনি পুস্কারের অর্থ দান করেন। উক্ত দানের অর্থ দিয়ে তার স্মৃতি রক্ষার্থে দীঘি সংস্কার কমিটি অনন্যা চন্দ্রা নাম সূচক সুদৃশ্য ঘাটলা নির্মাণ করেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নান্দনিকতায় পরিপূর্ণ এর চারপাশ।
উলপুর জমিদার বাড়ি
গোপালগঞ্জ সদর থেকে প্রায় ৮কিঃমিঃ উত্তরে অবস্থিত উলপুর গ্রাম। জানা যায় উলপুরের জমিদারেরা ছিলেন একশত ঘর শরীক। গ্রামটিতে এখনো টিকে আছে শতাব্দী প্রাচীন বেশ কয়েকটি বৃহদাকার দালান কোঠা। এর মধ্যে ৭/৮টি রয়েছে দোতালা দালান। জমিদারী প্রথা কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও জমিদারদের পরিত্যাক্ত বিল্ডিং গুলো কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে রয়েছে স্বগর্বে। পুরাতন বিল্ডিং গুলো উলপুর তফশীল অফিস, পুরানো ইউনিয়ন বোর্ড অফিস সহ স্বাস্থ্য কেন্দ্র, সাব পোষ্ট অফিস, পুরানো সরকারী শিশু সদন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জায়গাটির সাথে সোনারগাঁও পানাম নগরী’র কিছুটা মিল পাওয়া যায়। গোপালগঞ্জ কুয়াডাংগা বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস যোগে উলপুর চলে গেলে এই বাড়ি দেখতে পাওয়া যায়।
বধ্যভূমি স্মৃতি সৌধ
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা সংলগ্ন ৭১ এর বধ্যভূমি (জয়বাংলা পুকুর) হচ্ছে এলাকাবাসীর স্মৃতি বিধুর স্থান। শত শত মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিকামী বাঙ্গালীর আত্মহুতির নীরব সাক্ষী এ বধ্যভুমি। এখানে বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সমর্থকদের ধরে এনে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হতো। পাকবাহিনী কর্তৃক জয়বাংলা পুকুর নামকরণ করে সেখানে মৃত দেহ টেনে হেচড়ে ফেলা হতো আর জয় উল্লাস করা হতো। ১৯৭২ সালে বাঙালী জাতির প্রথম বিজয় দিবস উপলক্ষে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয় যা পরবর্তীতে দুস্কৃতিকারীরা ধবংস করে ফেলে। অতপর আলহাজ্ব সাইদুর রহমান (চানমিয়া) দীর্ঘ দিন চেষ্টার পরে তৎকালীন মাননীয় জেলা প্রশাসক জনাব সা জ ম আকরামুজ্জামান এবং সদর উপজলো নির্বাহী অফিসার জনাব মোঃ সাইফুল ইসলাম ১৯৯০ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান করেন।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের পৈতৃক বাড়ি
গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়া উপজেলার উনশিয়া গ্রামে গণজাগরণের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য এর পৈতৃক বাড়ি অবস্থিত। ১৯৪৬ সালে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের বাবা চাকরির সুবাদে কলকাতা চলে যাওয়ায় বাড়িটি জনমানবশূন্য হয়ে পরে। পরবর্তীতে ভট্টাচার্য বংশের সর্বশেষ পুরুষ বাড়িটির কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করলেও পর্যায়ক্রমে বাড়িটি দখলদারদের হাতে চলে যায়। পরবর্তীতে গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসকের নির্দেশ অনুযায়ী বাড়িটি সংরক্ষণ করা হয়, এবং ২০১০ সালে ৫০০ বছর বয়সী বাড়িটিকে সংস্কার করে একটি গ্রন্থাগারে রূপ দেয়া হয় যেখানে একটি অডিটোরিয়াম ও আছে। গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে কবির প্রতিকৃতি, বিশেষ কীর্তিস্তম্ভ, এবং দৃষ্টিনন্দন হরেক ফুলগাছ। পাঠকদের জন্য আছে কবির লেখা অনেক বই । সাহিত্যপ্রেমীদের জন্য এই ভিন্ন রকমের গ্রন্থাগারটি বেশ জনপ্রিয়।
উজানীর জমিদার বাড়ি
মুকসুদপুর উপজেলার উজানী গ্রামে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এই প্রাসাদটির অবস্থান। ইতিহাস বলে, ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলাদেশের যশোর জেলা হতে রায় গোবিন্দ এবং সুর নারায়ণ নামক দুই জমিদার বংশ গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর আসেন এবং সেখানে বসতি গড়ে তোলেন, এবং দ্বিতল, ত্রিতল প্রাসাদ নির্মাণ করেন, যেগুলো বর্তমানে উজানীর জমিদার বাড়ি নামে আখ্যায়িত।
সড়ক পথে ঢাকা থেকে গোপালগঞ্জের মুকসেদপুর এসে সেখান থেকে বাসে অথবা ব্যটারী চালিত অটো/ভ্যান/নসিমনে উজানী বাজারের দক্ষিণ দিকে ২০০ মিটার গেলে উজানী রাজবাড়ীতে পৌছানো যায়।
উলপুর জমিদার বাড়ি
১৯০০ শতকের দিকে জমিদার প্রীতীশচন্দ্র রায় চৌধুরী নামক একজন রাজকর্মচারী প্রায় ২০০একর জায়গা জুড়ে এই প্রাসাদের নির্মাণ করান। এখানে মূল ভবনের পাশাপাশি ছিল নাটঘর, মেজ, ছোট বাবুর বাড়ি এবং একটি শ্মশান।
গোপালগঞ্জ জেলায় আরও বেশ কিছু জমিদার বাড়ি, মঠ, তীর্থভূমি, এবং মসজিদ রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে অধিকাংশ জমিদার বাড়ি সংরক্ষনের অভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় রূপ নিয়েছে, কিছু ভবন শিক্ষা কার্যক্রম ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আবার কিছু স্থান যথাযথ প্রশাশনের আওতায় এনে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
Add comment