আমরা বাঙালীরা বিভিন্ন উৎসবে বাড়ীর আঙিনায় বা ঘরে আলপনা দিয়ে থাকি। কিন্তু এই আলপনা যদি হয় সবসময়ের জন্য তাহলে সেটা কেমন হবে? এবং এর সাথে সবসময় একটা উৎসব মুখর পরিবেশ। এটা স্বপ্ন মনে হলেও বাস্তব আর এই পরিবেশ উপভোগ করতে হলে আপনাকে যেতে হবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরে নাচোল উপজেলার আলপনা গ্রাম টিকইল। সেখানে যওয়ার পর আপনার কাছে মনে হবে আপনি হয়তো কোন আর্টগ্যালারী বা কোন উন্মুক্ত ক্যানভাসে এসেছেন। টিকইলের মানুষগুলো তাদের বাড়ীর দেয়ালগুলো ফুটিয়ে তোলেন নান্দনিক সব আলপনা দিয়ে। তাই গ্রামটি দেশ- বিদেশের অসংখ্য মানুষের কাছে এখন আলপনা গ্রাম (The Alpona Village/ A village of Alpona) নামে পরিচিত।
ঘুরে আসি চাঁপাইনবাবগঞ্জের আলপনা গ্রাম টিকইল
গ্রামটি মানুষের বাসস্থান, দর্শনীয় স্থান না হলেও বিভিন্ন দেশের মানুষ দেখতেন আসেন এই সুন্দর সাজানো গোছানো আলপনা আঁকা গ্রামটি দেখতে। আলপনা গ্রাম টিকইল এর বাসিন্দা দাসু বর্মণের বাড়িতে দর্শনার্থীদের জন্য একটি পরিদর্শন খাতা রাখা আছে। আলপনা গ্রামের সৌন্দর্য দেখে দর্শনার্থীরা পরিদর্শন খাতায় তাদের মন্তব্য লিখে রেখে যায়।
আলপনাগুলো সাধারণত গ্রামের গৃহিণী ও মেয়েরা এঁকে থাকে। বছরের পর বছর ধরে বংশ পরম্পরায় বাড়ীর দেয়ালে তারা তাদের ঐতিহ্যকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের এই শিল্পে বাদ যায় না তাদের রান্না ঘরও। সেখানেও তারা নানা রকম আলপনা দিয়ে ফুটিয়ে তোলে। আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে তারা আলপনার রং নিজেরাই তৈরি করে এবং এর প্রধান উপাদান হচ্ছে মাটি।
আলপনা তৈরির উপকরণঃ
এক সময় এসব আলপনা আঁকার জন্য চক, গিরিমাটি, রং, তারপিন তেল ব্যবহার করা হত। কিন্তু, সেইসব আলপনার স্থায়িত্ব ছিল কম। তাই এখন গিরিমাটি, শুকনা, বরই চূর্ণ আঠা, আমের পুরাতন আঁঠির শাঁস চূর্ণ, চকগুরা, বিভিন্ন রং, মানকচু ও কলা গাছের কস দিয়ে তৈরি মিশ্রণকে ৪-৫ দিন ভিজিয়ে রেখে আলপনা আঁকা হয়। আর এই আলপনা টিকে প্রায় ১ বছরেরও বেশি সময়।
আলপনা গ্রাম টিকইল এ আলপনা দেয়ার উদ্দেশ্যঃ
বিভিন্ন উৎসব যেমন পূজা ও নানা ধর্মীও অনুষ্ঠানে ঘরের ও বাড়ীর সৌন্দর্য বর্ধনে আলপনার প্রচলন শুরু হয়। এছাড়াও বাড়ীর ছেলে মেয়েরা প্রতিযোগিতা করে নানা ধরনের আলপনা করে থাকে।
আলপনার বিষয়বস্তুঃ
গ্রামের সবাই আলপনার কারিগর। বংশ পরম্পরায় তারা আলপনার ঐতিহ্যকে এতদূর এগিয়ে এসেছেন। গাছ, লতা – পাতা, পাখি, নদ- নদীসহ গ্রামবাংলার সৌন্দর্য ওঠে তুলির প্রতিটি টানে। বাংলার ষড়ঋতু গ্রামের দেয়ালে দেয়ালে ফুটে থাকে আলপনা হয়ে। বাড়ির দেয়ালে আঁকা আলপনা যাতে নষ্ট হয়ে না যায় সেজন্য অনেকেই ঘরের চালে পলিথিন বেধে রাখেন। বৃষ্টি হলেই খুলে দেন আবার বৃষ্টি কমে গেলেই গুটিয়ে ফেলেন। বধূরা তাদের হাতের ছোঁয়ায় এই ঐতিহ্যকে চলমান রেখেছেন যুগের পর যুগ। বিশেষ করে গ্রামটির ঘরে ঘরে যেন নারীরা হয়ে উঠেছেন একজন দক্ষ চিত্রশিল্পী। আলপনা আঁকতে যেন এদের কোন ক্লান্তি নেই।
আলপনা চর্চার ইতিহাসঃ
স্থানীয়দের মতে, অনেক আগে থেকেই এই গ্রামে আলপনা আঁকার রীতি চলে আসছে। অনেক আগে বিভিন্ন পূজা – পার্বণে এখানকার হিন্দু পরিবারের বউরা দেয়ালে সাদা রঙের তিনটি ফোঁটা এঁকে তাঁর নিচে দাগ দিয়ে খুব সুন্দর আলপনা আঁকতেন।তবে এখন তিন ফোঁটার সাদা আলপনা নয় , কল্পনার সব রঙেই ব্যবহার করা হয়। কল্পনার নানা চিত্র ফুটে ওঠে আলপনার মধ্য দিয়ে। লাল নীল সাদাসহ হরেক রকমের প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও আগেরদিন ছেলের জন্য পাত্রী দেখার সময় মেয়ের বাড়ির আলপনা দেখতেন বয়স্করা। তারপর থেকেই আলপনা অঙ্কনের প্রচলন শুরু হল।
কিভাবে যাবেন আলপনা গ্রামঃ
আপনি বাংলাদেশের যেই প্রান্ত থেকেই যেতে চান না কেন, আপনাকে বাস অথবা ট্রেনে যেতে হবে চাপাইনবাবগঞ্জে। অথবা, আপনি চাইলে রাজশাহী গিয়ে বাসে চাপাইনবাবগঞ্জে যেতে পারেন। চলে যাবেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের ডাইংপাড়ায় এবং সেখান থেকে রওনা দিবেন আমনুরার উদ্দেশ্যে। এরপর অটো বা সিএনজি তে আপনি যেতে পারবন আপনার গন্তব্য স্থল টিকইলে।
কন্টেন্ট রাইটারঃ দেবযানী দত্ত
Add comment